নিরাপত্তা দিতে না পারার দায় এড়াবেন কীভাবে - Independent Human Rights Defender, Bangladesh

Latest

Wednesday, October 20, 2021

নিরাপত্তা দিতে না পারার দায় এড়াবেন কীভাবে


নাগরিক সমাজের কথিত অগ্রসর অংশ সংস্কৃতিকর্মী, লেখক, আইনজীবী, বুদ্ধিজীবীদের প্রতিক্রিয়াতেও অদ্ভুত রকমের মিল। কুমিল্লার হামলার পর চার দিন পার হলেও সংস্কৃতিকর্মীরা কেউ রাস্তায় নেমেছেন এমন কোনো খবর চোখে পড়েনি। অন্যান্য পেশাজীবীর সমিতিগুলোও নীরব। লেখকদের কয়েকজনের একটি বিবৃতি ছাপা হয়েছে, তবে তাতেও পরিচিত মুখগুলো অনুপস্থিত। এর সম্ভাব্য ব্যাখ্যা কী? একটা ব্যাখ্যা হতে পারে দেশে যে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, তাতে সরকার রুষ্ট হয় এমন কিছু বলে কেউ নিজের বিপদ ডেকে আনতে চান না। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা আর গ্রেপ্তারের পরিসংখ্যান তো তাঁদের জানাই আছে। আরেকটি ব্যাখ্যা হচ্ছে, আমাদের সুশীল সমাজের স্বাভাবিক পক্ষপাত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতি হওয়ায় তাঁরা নিজেদের দলকে বিব্রত করতে চান না, দলের ক্ষতি করতে চান না। বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে তাই নাগরিক অধিকার রক্ষায় তাঁরা যতটা সোচ্চার হন, আওয়ামী লীগের সময় ঠিক ততটাই নীরবতা অনুসরণ করেন।

জননিরাপত্তায় প্রিভেনটিভ বা নিবৃত্তিমূলক আগাম ব্যবস্থা গ্রহণ একটি বহুল স্বীকৃত ও ব্যবহৃত কৌশল। গত এক দশকে দেখা গেছে, রাজনৈতিক প্রতিবাদ-বিক্ষোভ মোকাবিলায় পুলিশ প্রায়ই নিবৃত্তিমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে। রাজনৈতিক কর্মসূচির প্রস্তুতির খবর পুলিশ ঠিকই আগাম পেয়ে গেছে এবং গণহারে ধরপাকড় চালিয়ে এবং তিন-চার স্তরের নিরাপত্তাবেষ্টনী গড়ে সেগুলো ভন্ডুল করে দিয়েছে। এই কৌশল যে শুধু ঢাকার বেলায় অনুসৃত হয়েছে, তা নয়, মফস্বলের জেলাগুলোতেও হয়েছে। এমনকি যানবাহন অঘোষিতভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। শহরে বহিরাগতদের প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়েছে, বিজিবিও মোতায়েন করা হয়েছে।

পূজার সময়ে হাঙ্গামার আশঙ্কা তৈরি হওয়ার পরও এবার সে রকম কিছু হয়নি। তাহলে এবারে কি গোয়েন্দারা নিষ্ক্রিয় ছিলেন? পুলিশের তরফ থেকে কেন এবারে কোনো নিবৃত্তিমূলক পদক্ষেপ দেখা গেল না? তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া হয় যে কুমিল্লার ঘটনার জন্য প্রস্তুত থাকা সম্ভব ছিল না, কিন্তু অন্যান্য জেলার ক্ষেত্রে কেন তেমনটা হয়নি? ২০টির বেশি জেলায় সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার কারণে প্রশ্নটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ওই সব জেলায় কুমিল্লার হাঙ্গামার পরপরই বিজিবি মোতায়েন কিংবা ১৪৪ ধারা জারির মতো পদক্ষেপ নেওয়াই কি প্রত্যাশিত ছিল না? হাজীগঞ্জ, চৌমুহনী, চট্টগ্রাম, রংপুর—সব জায়গা থেকেই পুলিশের বিলম্ব, নয়তো অপর্যাপ্ত ব্যবস্থার অভিযোগ করা হয়েছে। কুমিল্লার ঘটনারও যে বিবরণ প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য সূত্রে উঠে এসেছে, তাতে যে মণ্ডপে ঘটনার সূত্রপাত, সেখানে যে নির্দেশনা সত্ত্বেও সিসি ক্যামেরা ও পাহারাদার ছিলেন না, তা মোটামুটি নিশ্চিত। পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন কেন এগুলোর ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারেনি? এমন তো নয় যে আমাদের পুলিশের লোকবল নেই, বা সম্পদের অভাবে তারা জননিরাপত্তা দিতে পারছে না। জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা খাতে চলতি বছরের বাজেটে বরাদ্দ আছে ২৮ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা। এখন তারা নিজস্ব হেলিকপ্টার কেনার কথাও ভাবতে পারে।

এগুলোকে অনেকেই ষড়যন্ত্রের আলামত গণ্য করছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও একে পরিকল্পিত আক্রমণ বলে অভিহিত করেছেন, তবে তাঁর সন্দেহের কারণ স্পষ্ট নয়। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, কারা, কোন উদ্দেশ্যে এ ধরনের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র করতে পারে? উদ্দেশ্যটা রাজনৈতিক না অর্থনৈতিক স্বার্থের, তা কোনো দিনই হয়তো জানা যাবে না। কোনো বহিঃশক্তির হাত আছে কি না, তা নিয়েও প্রচুর জল্পনাকল্পনা চলতে পারে। কিন্তু এসব সহিংসতা ও হাঙ্গামায় রাজনীতির যোগসাজশ কিংবা ষড়যন্ত্রের কথা যাঁরা বলছেন, তাঁদের আগে খুঁজতে হবে ওপরের প্রশ্নগুলোর উত্তর। পুলিশ ও প্রশাসন বিরোধী দলের ইঙ্গিতে নিষ্ক্রিয় ছিল—এমন কথা আমাদের বিশ্বাস করতে বললে, বুঝতে হবে, সেটাও রাজনীতিরই অংশ। সাধারণ মানুষ কেন হামলা প্রতিরোধে এগিয়ে আসেনি, কেউ কেউ এমন সমালোচনাও করেছেন। তবে রাজনীতিকেরা যেখানে নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ, সমাজের অগ্রসর অংশ যেখানে নীরবতা পালনকে শ্রেয় জ্ঞান করছেন, সেখানে কোন ভরসায় সাধারণ মানুষ পথে নামবে?

অনেকে এই সহিংসতার পেছনে সম্ভাব্য ষড়যন্ত্র ও তার জন্য নির্বাচনী রাজনীতির প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। কিন্তু নির্বাচন তো এখনো বছর দুয়েক দূরে। নির্বাচনী প্রস্তুতির কথা তো ক্ষমতাসীন দল ছাড়া এখনো অন্য কোনো দলের মুখে শোনা যায়নি। সম্ভাব্য ষড়যন্ত্র তত্ত্বের প্রবক্তাদের কেউ কেউ অবশ্য প্রতিবেশী দেশের বিভিন্ন রাজ্যের নির্বাচন ও উপনির্বাচনের কথাও বলেছেন। কেন্দ্রে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা বিজেপি বিভিন্ন কারণে জনপ্রিয়তা হারানোর পটভূমিতে তাদের দাবি, বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর হামলার কারণে বিভিন্ন রাজ্যে বিজেপির ভোট দ্বিগুণ হবে।

অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশেষত টুইটারে ভারতের প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সতর্কবার্তাও কিছুটা আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বাংলাদেশে হিন্দুদের নিরাপত্তা নিয়ে ভারতকেও সচেতন হতে হবে উল্লেখ করে তাঁর মন্তব্য, ‘সেখানেও (ভারতে) এমন কিছু যেন না করা হয়, যার প্রভাব আমাদের দেশে এসে পড়ে, আর আমাদের হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আঘাত আসে।’ নিঃসন্দেহে এটি ব্যতিক্রম। ভারতের সংবাদমাধ্যমগুলো যখন বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নিয়ে নানা ধরনের বিশ্লেষণ ও জল্পনা তুলে ধরছে, তখনো আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে ভারতের সংখ্যালঘুদের নিগ্রহ ও দুর্ভোগ জায়গা করে নিয়েছে। ১৮ অক্টোবর নিউইয়র্ক টাইমস আসামের বাংলাভাষী মুসলমানদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদের এক সরেজমিন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে (এমিড ফ্লেমস অ্যান্ড গানফায়ার, দে ওয়্যার ইভিক্টেড ফ্রম হয়্যার দে কলড হোম)।

গত কয়েক দিনের সাম্প্রদায়িক সহিংসতা যে দেশের সাধারণ মানুষকে ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত করেছে, সন্দেহ নেই। একইভাবে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে আন্তর্জাতিক পরিসরে যে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা-ও বলার অপেক্ষা রাখে না। ভারতের বিজেপির রাজ্য পর্যায়ের কিছু নেতা এবং হিন্দু সংগঠন, ইসকন বাংলাদেশে তদন্ত দল পাঠানোর জন্য জাতিসংঘের কাছে চিঠি দিয়েছে বলে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। এগুলো উদ্বেগের বিষয় ঠিকই, তবে তার চেয়েও বড় উদ্বেগের কথা হচ্ছে ক্ষমতাসীনদের দায়িত্ব এড়ানোর প্রবণতা। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না কিংবা দোষীদের আইনের আওতায় আনা হবে—এগুলো হচ্ছে অতিব্যবহৃত প্রতিশ্রুতি, যা সাধারণত পূরণ হয় না। দায়িত্বশীলেরা তাঁদের ব্যর্থতার দায় স্বীকার করলেই আমরা ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিতে পারি। আর তাহলেই এ ধরনের নাশকতা ও সহিংস অঘটনের পুনরাবৃত্তি এড়ানো সম্ভব হবে।

  • কামাল আহমেদ সাংবাদিক

Endless gratified thanks for reading / watching /listening

No comments:

Post a Comment

Please validate CAPTCHA