‘স্বর যেন কখনো বিক্রি না করি’
আসল নাম তার ওয়াজকুরুনি ফকির সাহেব। এখন তিনি ফকির সাহেব নামেই বেশি পরিচিত। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ব বিভাগের ৪৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী।
বৈচিত্র্যপূর্ণ এক জীবন সঞ্চয়ে আছে তার। সেই জীবনকে যাপন করা হয় না, উদযাপন করতে হয়। লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার ভোতামারি ইউনিয়নে তার বাড়ি। কিন্তু তার শেকড় আরো গভীরে প্রোথিত নির্জন প্রকৃতি, গাছপালা, মাটি ও মানুষের সঙ্গে।
শাহ আব্দুল করিমের ‘মানুষ থুইয়া খোদা ভজে এই মন্ত্রণা কে দিছে?’ এই জীবনদর্শনে তিনি বিশ্বাসী। মা, দুইবোন ও ভাগ্নে-ভাগ্নিদের নিয়ে তার পরিবার। বড় বোন বুলবুলি, মেঝ বোন সুন্দরীর একমাত্র ভাই ফকির সাহেব।
ফকির সাহেবের গান এখন মানুষের মুখে মুখে। শঙ্খচিলের পক্ষ থেকে তার সঙ্গে আলাপ করেছেন কাজী তাহমিনা
১-আপনার শৈশব-কৈশোরকাল সম্পর্কে, পরিবার সম্পর্কে জানতে চাই
আমার শৈশব কৈশোরকাল কেটেছে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের দুই বিশাল বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে। সে অনেক কথা। কারণ শৈশব-কৈশোরে ছিলাম স্বাধীন। বাড়ি থেকে তেমন কোনো কঠোর শাসন না থাকার কারণে বন্ধু, সহপাঠীদের সাথে প্রায়ই নদীর হাঁটু জল পার হয়ে পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি দেওহাটা ঘুরে বেড়িয়েছি।
সেই শৈশব থেকেই হাঁটতে-হাঁটতে ঘুরতে ঘুরতে খোল নিয়ে গান করেছি। বন্ধুদের সাথে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি। হাতীবান্ধা, দইখাওয়ায় গিয়েছি ভজন শুনতে। আবার কখনো কখনো বাড়ির পাশে হিন্দুবাড়িতে কীর্তন শুনতে শুনতে ভোর হয়েছে। বাবার কাছে বাড়িতে শুনতাম দেহতত্ত্ব, মারফতি, লালন গান। বলতে পারেন, আমার শৈশব কৈশোরের বড় একটা সময় এই গানের মাধ্যমে অতিবাহিত হয়েছে।
পরিবারে মা, আমি আর ভাগ্নে-ভাগ্নিকে সাথে নিয়ে আছি।
২– নিজের সম্পর্কে ৫ টি মজার / অদ্ভূত তথ্য দিন, যা আপনার ভক্তরা জানে না
নিজের সম্পর্কে আসলে আমার বলার কিছুই নেই। আমি সকলের মাঝে উন্মুক্ত, আমার নিজের অজানা বলে কিছু নেই। তবুও কিছু বলছি।
-আমার কোনো নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেল নেই।
-আমার নিজের কোনো মৌলিক গান নেই। যে গানগুলো আমি নিয়মিত করি, সেগুলোর পদকর্তা হচ্ছেন বিভিন্ন সাধক। যেমন: আমার প্রথম ভাইরাল হওয়া গান ‘ভাব আছে যার গায়’ গানটির পদকর্তা ও সুরকার ছিলেন ভিক্ষু সাধু। আমার বেশিরভাগ গাওয়া গানের পদকর্তা ও সুরকার হচ্ছেন ভিক্ষু সাধু। এছাড়াও বাউল শাহ আব্দুল করিম, হাছন রাজা, রশিদ সরকারসহ বিভিন্ন সাধকের গান আমি গাই।
-গানের সাথে যন্ত্রের একটা অদ্ভূত সম্পর্ক আছে। তা আমরা সবাই জানি। কিন্তু আমি শুধু খালি গলায় গান গেয়ে তৃপ্তি অনুভব করি।
-কোলাহলপূর্ণ এলাকা, জনসমাগম আমার সহ্য হয় না। নির্জনতা, নিস্তব্ধ প্রকৃতি ও সবুজ পরিবেশ আমার ভীষণ পছন্দ।
– জীবনে প্রচুর পিঁপড়া খেয়েছি, কিন্তু সাঁতার শেখা হয়নি।
৩– শুনেছি, আপনি গান গেয়ে কোনো সম্মানী নেন না। এ বিষয়ে আপনার দর্শন জানতে চাইছি।
– প্রথমেই একটা কথা বলতে চাই, আমার মা বলেছিলেন যে, অনেক অনেক মানুষের কানে আমার স্বর পৌঁছে যাবে। কিন্তু স্বর যেন কখনো বিক্রি না করি । গান কখনোই আমার পেশা নয়। আর গানকে কখনোই আমি পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে চাই না । গানকে আমি ভালোবাসি । আমি গান গাই নিজের তৃপ্তির জন্য। গান আমার ভালোবাসা, গান আমার প্রেম।
এখন বলেন, ভালোবাসার ক্ষেত্রে কী কোনো সম্মানী বা লেনদেন প্রযোজ্য?
৪– বিশ্ববিদ্যালয়ের/ প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা কেমন লাগে? আপনার ভক্তরা দেখা হলেই কী গান শুনতে চান?
বিশ্ববিদ্যালয়/ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অনেক বড় ব্যাপার। সবার ভাগ্য হয় না এমন বিদ্যাপীঠে জ্ঞানার্জন করার। কিন্তু, বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা আমার একদমই পছন্দ নয়। কারণ, বর্তমান সময়ে পড়াশোনা নোট, নেট, শিট, গুগল- এগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ। আমি কখনোই এগুলো থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি না।
আর ভক্তরা দেখা হলেই গান শুনতে চান কিন্তু আমি গাই না ।কারণ ভাব সবসময় হয় না। আর ভাব সময় আসেও না।
৫– খ্যাতির বিড়ম্বনায় পড়েছেন–এমন কোনো অভিজ্ঞতা আমাদের সাথে শেয়ার করবেন কি?
গত ১৭ ফেব্রুয়ারি স্বরস্বতী পূজা উপলক্ষে ক্যাম্পাসের ছোট ভাইয়ের বাসা মানিকগঞ্জে একটা প্রোগ্রামে গেলাম। গান শেষ হওয়া মাত্রই একজন মানুষ আমাকে জাপ্টে ধরে। কেউ আমার শরীরটা ধরে টানছে। কারণ, কেউ গান শুনবে, কেউ ছবি তুলবে, আবার কেউ কথা বলবে। কোনভাবে আমার ম্যানেজার ও টিম মেম্বাররা আমাকে উদ্ধার করে। শেষে এক গাড়িতে উঠে বসি। এরকম অবস্থার মুখোমুখি বহুবার হয়েছি। এতে আমার মনে ক্ষোভ নেই। আমিও হয়তো তাদের জায়গায় থাকলে একই কাজ করতাম।
৬– জীবনসঙ্গী হিসেবে কেমন মানুষ চান?
-এখন পর্যন্ত জীবনসঙ্গী নির্বাচন করি নাই। তবে, একটি ইহুদি মেয়ের প্রেমে পড়েছিলাম। পরবর্তীতে সে আত্মহত্যা করে। তবে আমি জীবনসঙ্গী হিসেবে তাকেই চাই যে নিজেই নিজেকে বুঝতে পারবে পরিপূর্ণভাবে। আমাকে নয়।
৭– আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে বলুন, প্লিজ।
-তুমি যে যুগে বিদ্যমান আমি সেই যুগেই বর্তমান। তাই ভবিষ্যত ভবিষ্যতের কথা বলবে। দেখা হবে।
৮- শহর না গ্রাম কোথায় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?
-শহর না গ্রাম, এখানে নিঃসন্দেহে গ্রামের কথাই বলতে হবে। কারণ নির্জনতা, নিস্তব্ধ, সবুজপ্রকৃতি একমাত্র গ্রামেই সম্ভব। দিগন্তজোড়া মাঠ, মেঠোপথ, পাখির কিচিরমিচির, নদীর শীতল বাতাস এগুলোতে পরিপূর্ণ আমার গ্রাম, আমার জন্মভিটা।
তাই বারবার আমাকে আমার সীমান্তবর্তী গ্রামেই আপন করে নেয়। শহর কখনোই আমাকে তৃপ্তি দেয় না। এই যন্ত্রের যান্ত্রিক শহরে যান্ত্রিক মানুষ হয়ে বেঁচে থাকাটা আমার জন্য বহু কঠিন।
৯– এতো চমৎকার দরদ দিয়ে গান করার রহস্য কী?
-চমৎকার দরদ দিয়ে গান করতে পারে কিনা জানি না। তবে একটা বিষয় খেয়াল করবেন, আমার বেড়ে ওঠা যে অঞ্চলে সে অঞ্চলের মানুষের ভাষার মধ্যে আলাদা একটা টান আছে। বলার মধ্যে একটি ভঙ্গি আছে। যেগুলো একদম সরল মনের ভাষা। শান্তি দেয়, মনে আরাম দেয়। সে ভাষা হলো মাটির ভাষা। আর মাটি মানেই দরদ। আদর, ভালোবাসা।
আর আমি যখন গান গাই, তখন তো কারো না কারো সাথে কথা বলি। আমার বলাটা হয় মাটির ভাষাতেই, মাটির সুরেই।
১০– ভক্তদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন
-ভক্তদের উদ্দেশ্যে বলব, আদি মানব বাদে বর্তমান সময় পর্যন্ত পৃথিবীতে যত মানব-মানবী এসেছেন, তাদের মাধ্যম পিতামাতা। বর্তমান সময়ে, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মাঝে পিতামাতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল আচরণ খুব কম দেখতে পাই।
তাই আমার ভক্ত যদি কেউ থাকে, তাকে বিনীতভাবে অনুরোধ করব, পিতা-মাতাকে যেন পীর-মুর্শিদের ন্যায় শ্রদ্ধা ভক্তি দিয়ে সর্বোচ্চ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হন। কারণ, জেনে থাকবেন পিতা-মাতা তুল্য বড় কোনো পীরমুর্শিদ নেই দুনিয়াজুড়ে।
আরেকটা কথা হচ্ছে বর্তমান সময়ে ভালো মনের মানুষের খুব অভাব। আমি একটা বিষয় খেয়াল করেছি যে মানুষ গান শুনে না, সে কখনোই ভালো মানুষ হতে পারে না। তাই সবাই গান শুনবেন, গুনগুন করবেন। দেখবেন নিজের মধ্যে তৃপ্তিবোধ করছেন।
Endless gratified thanks for reading / watching /listening
No comments:
Post a Comment
Please validate CAPTCHA