প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদাকে ‘খলনায়ক’ আখ্যা দিয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, ‘নতুন আইনে এরকম লোকদেরই নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে।’ দুই দিন আগে একটি অনুষ্ঠানে দেওয়া সিইসি’র বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে শনিবার (২৯ জানুয়ারি) ভার্চুয়াল একটি সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই মন্তব্য করেন। এর আয়োজন করেছে নাগরিক সংগঠনটি।
এক প্রশ্নের জবাবে নির্বাচনে অনিয়মের তথ্য তুলে ধরে টিআইবির গবেষণা ও বিবিসির খবরের বরাত দিয়ে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘অনেক অনিয়ম হয়েছে, যেগুলোর বিচার হয়নি। বিচার করার অভিপ্রায়ও তাদের ছিল না। আমাদের দুর্ভাগ্য এরকম একজন খলনায়ককে নির্বাচন কমিশনের প্রধান হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যে আইনটা করা হয়েছে, তাতে দুর্ভাগ্যজনকভাবে এরকম লোকদেরই নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে।’
গত ২৭ জানুয়ারি নির্বাচন ভবনে রিপোর্টার্স ফোরাম ফর ইলেকশন অ্যান্ড ডেমোক্রেসির (আরএফইডি) সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ টি এম শামসুল হুদা এবং সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারের সমালোচনা করেন সিইসি।
বদিউল আলম মজুমদার বর্তমান কমিশনকে ‘অদক্ষ’ আখ্যা দিয়ে ভোটে ‘অনিয়ম’ এবং নির্বাচন ব্যবস্থা ‘ভেঙে দেওয়া’সহ বিভিন্ন অভিযোগ করে আসছেন।
সেই প্রসঙ্গ টেনে কে এম নূরুল হুদা বলেন, ‘পূর্ব পরিচিত হলেও সুজনের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মসহ বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সংগঠনটিকে কোনও কাজে সম্পৃক্ত করেনি বর্তমান ইসি।
সিইসি’র দাবি, সুজন সম্পাদক দুই বছর তার ‘পেছনে ঘুর ঘুর করেছেন’। এছাড়া তার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করে কাজ চেয়েছেন সুজন সম্পাদক।
নবম সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা সুজনকে প্রার্থীদের হলফনামা প্রচারের কাজ দেওয়ার সমালোচনা করেন কে এম নূরুল হুদা।
আজকের সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়েন সুজনের সদস্য সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। সুজনের বক্তব্যে বলা হয়, ‘এক কোটি টাকার অনিয়মের অভিযোগসহ কিছু কুরুচিপূর্ণ, অশালীন, অসত্য বক্তব্য দিয়েছেন সিইসি। দেশের মর্যাদাপূর্ণ একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদে বসে তাকে এমন মিথ্যাচার করতে দেখে আমরা হতবাক। নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে ড. বদিউল আলম মজুমদারের ব্যক্তিগত আর্থিক লেনদেনের কোনও সম্পর্ক নেই এবং কোনোদিন ছিল না উল্লেখ করে বলা হয়, কমিশন থেকে কখনও কোনও কাজ নেননি বদিউল আলম, অসমাপ্ত রাখার তো কোনও প্রশ্নই আসে না। অর্থাৎ ড. মজুমদারের বিরুদ্ধে সিইসির নিজের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী কানকথার ভিত্তিতে উত্থাপিত এক কোটি টাকা অনিয়মের অভিযোগ এবং কাজ নিয়ে কাজ না করার অভিযোগ সম্পূর্ণ বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তাই সিইসি হুদাকেই এসব অভিযোগের প্রমাণ দিতে হবে। একইসঙ্গে জবাব দিতে হবে যে, তার কাছে এ সম্পর্কে তথ্য যদি থাকেই তাহলে তিনি কেন তা প্রকাশ করলেন না? কেন অভিযোগের তদন্ত করলেন না? দুর্নীতি দমন কমিশনেই বা কেন তা পাঠানো হলো না?’
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘একটি বিতর্কিত নির্বাচনের অকাট্য কিছু প্রমাণ ও তথ্য প্রকাশ করায় সুজন ও ড. বদিউল আলম মজুমদারের ওপর কে এম নূরুল হুদার ক্ষিপ্ত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। তাছাড়া ২০২০ সালের ডিসেম্বরে বৈশাখী টেলিভিশনের আট পর্বের একটি প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ৪২ জন বিশিষ্ট নাগরিক সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে নূরুল হুদা কমিশনের বিরুদ্ধে গুরুতর অসদাচরণ ও দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের যে আবেদন করেন, তাতে ড. বদিউল আলম মজুমদারসহ সুজন-এর অনেক নেতৃবৃন্দ ছিলেন স্বাক্ষরকারী। এজন্যই সিইসি’র গাত্রদাহ এবং নিজের অপকর্ম ও বাংলাদেশের নির্বাচনি ব্যবস্থাকে অকার্যকর করে জনগণের ভোটাধিকার হরণের পক্ষপাতদুষ্টতার কলঙ্ক আড়াল করতেই তিনি আমাদের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ তুলেছেন।’
লিখিত বক্তব্যে সিইসি’র সব অভিযোগ এবং সুজন সম্পাদকের বিরুদ্ধে বক্তব্যের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, ‘সিইসি হুদা নির্বাচন সম্পর্কে ড. মজুমদারের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা নিয়ে অশালীন মন্তব্য করেছেন। তার জানা থাকার কথা যে, ড. মজুমদার দেশ-বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু বছর শিক্ষকতা করেছেন। তিনি মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণকালীন প্রফেসর ছিলেন। তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত লেখক ও গবেষক। বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে তিনি একডজনের বেশি বই এবং অনেক বিদেশি জার্নালে প্রবন্ধ লিখেছেন। ২০ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি নির্বাচন নিয়ে কাজ করে আসছেন এবং এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছেন।’
সিইসি’র বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করবেন কিনা জানতে চাইলে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘একটা বড় প্রশ্ন, আদালতে গেলে রিমেডি পাওয়া যাবে কিনা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটা বিবেচ্য বিষয়। তবুও আলোচনা করবো। আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবো। অবশ্যই মানহানি হয়েছে। শুধু আমার নয়, পুরো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের মানহানি হয়েছে।’
সুজন কাজ পাওয়ার জন্য চিঠি দিয়েছে– সিইসি’র এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘কোনোদিনই সুজন, আমি নিজে কিংবা আমাদের প্রতিনিধি কাজ পাওয়ার ব্যাপারে কোনও আলাপ করেনি। চিঠিও দেয়নি। চিঠি দেওয়া হলে প্রকাশ করেন না কেন? এসব বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।’
সংবাদ সম্মেলনে আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার যা বলেছেন তাতে আমি আশ্চর্য হইনি। একটা পদে থাকলে তার যখন সমালোচনা করা হয়, সমালোচনার পাল্টা যদি কোনও সদুত্তর না থাকে, কৃতকার্যের ব্যাখ্যা না থাকে, তাহলে সবচেয়ে সহজ পন্থা হলো, সমালোচনাকে পাশ কাটিয়ে সমালোচককে ব্যক্তিগত আক্রমণ করা। এটা অবশ্যই নিকৃষ্ট পন্থা। রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে অনেক সময় এটা আমরা মেনে নিই। কিন্তু একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তির কাছ থেকে এটা অপ্রত্যাশিত। যদিও আমি আশ্চর্য হইনি, কারণ তিনি এভাবেই পাঁচ বছর কাটিয়েছেন। যত সমালোচনা, অযোগ্যতা, অদক্ষতা পক্ষপাতিত্ব হোক, কখনোই ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি। তার অসম্ভব বক্তব্য ছিল পাঁচ বছরের অন্যতম প্রধান কাজ। নিজের কৃতকার্য ও নির্বাচনকে নির্বাসনে পাঠানোর জন্য আমরা তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির যে অভিযোগ এনেছি তাতে আমার বিশ্বাস, এজন্য তাকে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে।’
সুজনের সভাপতি এম হাফিজউদ্দিন খানের মন্তব্য, ‘বর্তমান সিইসি নির্বাচন ব্যবস্থা ও নির্বাচন কমিশনের যে দুর্নাম জুটিয়েছেন সেজন্য তার শাস্তি হওয়া উচিত।’
সংবাদ সম্মেলনে আরও বক্তব্য দেন সাবেক বিচারপতি এম.এ মতিন এবং স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ।
Endless gratified thanks for reading / watching /listening
No comments:
Post a Comment
Please validate CAPTCHA