আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে তোমায় পাইনি!
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গানটি লিখেছিলেন কার উদ্দেশে! মানব-মানবী প্রেমে নাকি তিনি প্রেম নিবেদন করেছিলেন তাঁর স্রষ্টার প্রতি! রবীর প্রেম বা পূজা পর্বের প্রায় রচনাই দুভাবেই ব্যাখ্যা করবার প্রয়াস নেয়াই যায়। কবি হয়তো পাঠকজনের হাতেই সে ভার দিয়েছিলেন।
বাংলার মানুষের হিয়ার মাঝে লুকিয়ে আছে যে মানুষ তাকে কি আমরা দেখতে পাই! সেই মানুষ যে সামাজিক, আর্থনৈতিক, রাজনৈতিক আবহে আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে! যে মানুষ এই মাটি আর মানুষকে চিনিয়েছে আমাদের! যাঁর জীবনের একটা বিশাল সময় কেটেছে অন্ধকার কারাপ্রকোষ্ঠে! যাঁর জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল এদেশের মানুষের কল্যাণে! যিনি তাঁর দেহের শেষ রক্ত বিন্দুটি দিয়েছেন এই মাটির জন্যে! তাঁকে কি আমরা চিনতে পেরেছি?
তাঁকে চিনতে পারিনি! তিনিই তো শেখ মুজিবুর রহমান! যাদের কথা ছিল তাঁকে আমাদের কাছে তুলে ধরবার তাঁরাই পারেননি তাঁকে চিনতে। আমরা যারা তাঁকে দেখিনি, তাঁর সাথে পথে নামিনি তারা একটু একটু করে তাঁকে খুঁজে পেয়েছি, চিনেছি! যতই গভীরে যাই ততই বিস্ময়ে তাঁর দিকে তাকাই। চিনবার জন্যে, তাঁকে বুঝবার জন্যে আমাদের মস্তক ঊর্ধ্বমুখী করতে আমরা বাধ্য হই! এক বিশাল মহীরুহের মত তিনি আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হন আপন মহিমায়। আমরা সেই বিশাল বটবৃক্ষের ছায়াতলে শান্তির পরশ পাই!
যখন তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণারত হই তখন এক ঘোরের মাঝে হারিয়ে যাই। এই সেই মানুষ যাঁর কথায় আর কাজে ছিল না কোন বৈপরীত্য। তিনি বাংলার মানুষের জন্যে বলেছেন, তিনি বাংলার মানুষের জন্যে কাজ করেছেন। যা বলেছেন তাই করেছেন। এদেশের মানুষকে পাকিস্তানের ভয়াল থাবা থেকে মুক্ত করে একটি দেশ, একটি মানচিত্র, একটি পতাকা আর একটি জাতীয় সঙ্গীত তুলে দিয়েছিলেন বাংলার মানুষকে ১৯৭১ সালে। এদেশের মানুষের কাছে কারারুদ্ধ “শেখ মুজিব” হয়ে উঠেছিল এক হ্যামিলনের বাঁশীওলা। যাঁর এক ডাকে দেশের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা যার যা কিছু ছিল তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর উপর। সে জনযুদ্ধের ডাক তিনি যেদিন দিয়েছিলেন সেদিনই তিনি জানতেন যে এরপর আর তাঁর পিছুহটার কোন পথই খোলা থাকবে না। তিনি সে পথ খোলা রাখতে চাননি। যদি চাইতেন তবে তাঁর সামনে অসংখ্য প্রলোভনের দীর্ঘ পথ ছিল অবারিত। তিনি সেসব পথে হাঁটবেন না বলেই অকুন্ঠচিত্তে রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে বলতে পেরেছিলেন “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”!
তাঁর স্বাধীনতার চেতনার কথা বলতে গেলে কিছুটা পেছনে যেতে হয়। তিনি কিন্তু তখন আওয়ামী লীগের প্রধান নেতা নন। বলছি ৬০ এর দশকের গোরার দিকের কথা, যখন তিনি লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন, ষ্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান, এল.এস. (অব.) সুলতান উদ্দিন আহমদ, এল.এস.সি.ডি.আই. নূর মোহাম্মদ, আহমদ ফজলুর রহমান সি.এস.পি. প্রমুখের সাথে বৈঠক করছেন এবং তাঁদের সশস্ত্র বিদ্রোহের পরিকল্পনায় পূর্ণ সমর্থন দিচ্ছেন, দিচ্ছেন অর্থ যোগানের আশ্বাস কিম্বা অস্ত্র ও অন্যান্য সহায়তার জন্যে গোপনে আগরতলায় গিয়ে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্রলাল সিংহের সাথে বৈঠক করছেন! পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা সামরিক বাহিনীর কতিপয় বাঙালী সদস্য ও কিছু বাঙালী আমলা ও বেসামরিক বাঙালীর সশস্ত্র সংগ্রামের পরিকল্পনার কথা জানতে পারে। তারা খুঁজতে থাকে এর সাথে শেখ মুজিবুর রহমানের সংশ্লেষ। পেয়েও যায়। লাহোর, করাচী, রাওয়ালপিন্ডি, ঢাকা, চট্টগ্রামে হানা দিয়ে গ্রেফতার করে অসংখ্য বাঙালী সামরিক-বেসামরিক ব্যক্তিকে। জেল গেট থেকে শেখ মুজিবকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় ক্যান্টনমেন্টে। পরবর্তিতে শেখ মুজিবসহ আরো ৩৫ জনকে আসামী করে শুরু হয় “রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য” মামলা। এই তথাকথিত ষড়যন্ত্রের সাথে “ভারত” এর যুক্ততা বিশ্বাসযোগ্য করতে অনানুষ্ঠানিকভাবে মিডিয়ার কাছে এই মামলাকে পরিচিত করা হয় “আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা” নামে। শুরু হয় আটককৃতদের চরমতম শারিরিক ও মানসিক নির্যাতন। সাক্ষ্য নেবার সবরকম চেষ্টা করা হয় যাতে প্রমাণ করা যায় যে শেখ মুজিব পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছিল সশস্ত্র বিদ্রোহের। তাহলেই বাঙালীকে নেতৃত্বহীন করা যাবে শেখ মুজিবকে ফাঁসী দিয়ে। আইয়ুবের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়। মুজিবের বিরুদ্ধে নয় জনগণ জ্বলে ওঠে আইয়ুবের বিরুদ্ধেই। সার্জেন্ট জহুরকে হত্যা করে সে আগুনে ঘি ঢালে আইয়ুব নিজেই। রাজপথে জনতার ঢল নামে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে “চল চল ক্যান্টনমেন্ট চল” শ্লোগানে। আসাদ, মতিয়ুরের রক্তে উজ্জীবিত আন্দোলন রূপ নেয় গণঅভ্যুত্থানে। ২২ ফেব্রুয়ারী, ১৯৬৯, মাথা নামিয়ে আইয়ুব খান মামলা তুলে নিতে বাধ্য হয়, বাধ্য হয় অভিযুক্তদের মুক্তি দিতে।
এই মাত্রায় আমরা কি এক “বিপ্লবী মুজিব”কেই খুঁজে পাই না? সশস্ত্র সামরিক বিদ্রোহেও পিছপা হচ্ছেন না শেখ মুজিব স্বাধীনতার প্রশ্নে?
এই সশস্ত্র বিদ্রোহের পরিকল্পনার পাশাপাশি শেখ মুজিব তাঁর রাজনৈতিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতার প্রক্রিয়াও কিন্তু চালিয়ে গেছেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬৬তে আমরা পাই সেই বিখ্যাত “৬ দফা”! কি ছিল সেই ছয় দফায়?
১) লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংবিধান রচনা করে পাকিস্তানকে একটি
ফেডারেশনে পরিণত করতে হবে, যেখানে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার থাকবে এবং
প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ভোটে নির্বাচিত আইন পরিষদ সার্বভৌম হবে;
২) ফেডারেল সরকারের হাতে থাকবে শুধু দুটি বিষয়, প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক
সম্পর্ক, এবং অপর সব বিষয় ফেডারেশনে অন্তর্ভুক্ত রাজ্যসমূহের হাতে ন্যস্ত
থাকবে;
৩) পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুটি পৃথক অথচ সহজে বিনিময়যোগ্য
মুদ্রা চালু করতে হবে। যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে সমগ্র পাকিস্তানের জন্য
ফেডারেল সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন একটিই মুদ্রাব্যবস্থা থাকবে, একটি ফেডারেল
রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ও দুটি আঞ্চলিক রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থাকবে। তবে এক্ষেত্রে
পূর্ব পাকিস্তান থেকে পুঁজি যাতে পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হতে না পারে তার
ব্যবস্থা সম্বলিত সুনির্দিষ্ট বিধি সংবিধানে সন্নিবিষ্ট করতে হবে;
৪) দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পৃথক হিসাব থাকবে এবং অর্জিত বৈদেশিক
মুদ্রা রাজ্যের হাতে থাকবে। তবে ফেডারেল সরকারের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক
মুদ্রা দুই অঞ্চল থেকে সমানভাবে কিংবা উভয়ের স্বীকৃত অন্য কোনো হারে আদায়
করা হবে;
৫) দুই অংশের মধ্যে দেশিয় পণ্য বিনিময়ে কোনো শুল্ক ধার্য করা হবে না এবং
রাজ্যগুলো যাতে যেকোন বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন
করতে পারে সংবিধানে তার বিধান রাখতে হবে।
৬) প্রতিরক্ষায় পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে আধা-সামরিক
রক্ষীবাহিনী গঠন, পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র কারখানা স্থাপন এবং কেন্দ্রীয়
নৌবাহিনীর সদর দফতর পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপন করতে হবে।
আমার মনে হয় এই ৬ দফাকে একটি শব্দে যদি রূপান্তর করতে হয় তবে যে শব্দটি পাওয়া যাবে তা হচ্ছে “স্বাধীনতা”! কেননা এর প্রতিটি ছত্রে প্রচ্ছন্ন স্বাধীনতার আকাংখাই প্রকাশ পায় যদিও প্রত্যক্ষে রয়েছে “স্বায়ত্বশাসন”। ৬ দফা প্রণয়নে আওয়ামী লীগের সমর্থন আদায়ে বেগ পেতে হয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানকে। ছয় দফা অনুমোদনে অনুষ্ঠিত সভা থেকে এই ৬ দফা প্রণয়নকে একটি হঠকারিতা মনে করে সভাপতি সভাস্থল ত্যাগ করেছিলেন। শেখ মুজিবের যুক্তি ও দৃঢ়তায় সেদিন আওয়ামী লীগের অনুমোদন পেয়েছিল ৬ দফা। ছাত্র নেতাদের পূর্ণ সমর্থন না পেলে সেদিন ৬ দফা আলোর মুখ দেখতো কিনা কে জানে! আর সে ক্ষেত্রে হয়তো ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর হ’তো না এদেশের মানুষের ‘বিজয় দিবস”।
৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলার মানুষ পেলো তাদের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের একমাত্র মুখপাত্র হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ ১৬৯ টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে (মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত সাতটি আসন সহ) জয়লাভ করলো। আপামর জনগণ তাঁকে ছয়দফা মতবাদের পক্ষে নিরঙ্কুশ ম্যান্ডেট প্রদান করেছিল। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের সব প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে রমনা রেসকোর্সে একটি ভাবগম্ভীর অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন এবং শপথ নিলেন যে, পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের সময় তারা কখনও ছয়দফা থেকে বিচ্যুত হবেন না। কিন্তু এ পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কেন্দ্রে সরকার গঠন করতে না দেওয়ার জন্য জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সামরিক জান্তা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের নির্বাচিত নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলো। ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ১ মার্চ এক ঘোষণায় ৩ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন একতরফাভাবে স্থগিত করলো। ফলে পূর্ব পাকিস্তানে সর্বাত্মক বিক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠলো। বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের গোটা বেসামরিক প্রশাসন তাঁর নিয়ন্ত্রণে চলে এলো এবং তাঁর নির্দেশমত চলতে লাগলো। এরই ধারাবাহিকতায় ৭ মার্চ মুজিব রেসকোর্স ময়দানে দশ লক্ষ লোকের বিশাল জমায়েতে দিলেন তাঁর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ, ঘোষণা করলেন “স্বাধীনতা”র।
সহ্য করতে পারলো না পাকিস্তানী সামরিক জান্তা আর তাদের দোসর জুলফিকার আলী ভুট্টো। ২৫ মার্চে রাতের অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়লো পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বাংলার মানুষের উপর। বন্দী করলো বঙ্গবন্ধুকে, নিয়ে গেল পাকিস্তানে। তিনি রেখে গেলেন তাঁর যোগ্য সিপাহশালার তাজউদ্দিন আহমেদকে। যাঁর নেতৃত্বে সুপ্রিম কমান্ডার শেখ মুজিবের ডাকে ৯ মাস যুদ্ধ করে ৩০ লক্ষ শহীদের রক্ত আর ৭ কোটি মানুষের ত্যাগ-তিতিক্ষায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে পর্যুদস্ত করে মুক্ত হলো বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা। জয় হলো বাংলার, জয় হলো জনতার, জয় হলো মুজিবের!
বিদ্রোহী কবির ভাষায় বলতে পারি আমি চিনেছি আমারে আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ! আর তাই আমার হিয়ার মাঝে যিনি লুকিয়ে ছিলেন তাঁকে জেনেছি, চিনেছি! যিনি রয়েছেন বাংলার মানুষের মনের মন্দিরে, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাই আজ আত্মবিসৃত আমি লজ্জাবনত মস্তকে মুক্ত কন্ঠে বলতে পারি –
“গোপন রহি গভীর প্রাণে আমার দুঃখসুখের গানে
সুর দিয়েছ তুমি, আমি তোমার গান তো গাই নি॥”
https://bangalianaa.com/%E0%A6%86%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%B9%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%9D%E0%A7%87-%E0%A6%B2%E0%A7%81%E0%A6%95%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A7%87-%E0%A6%9B%E0%A6%BF-2/
No comments:
Post a Comment
Please validate CAPTCHA