ভাবেন রবীন্দ্রনাথ ভাবান অন্যে ভাব টানে -চৌধুরী মনজুর লিয়াকত - Independent Human Rights Defender, Bangladesh

Latest

Independent Human Rights Defender, Bangladesh

Mission: We champion human dignity, justice, and equality. Civic Vision: protect rights, fight injustice, and promote people-centred democracy. Vision: We envision a world with equal access to quality education for every child. Our initiative, "One World, One Identity, One Curriculum," embodies this fair, united future. Protecting Minorities: We are campaigning for a robust protection system for minority communities in Bangladesh, guaranteeing their safety, security, and equal citizenship.

Sunday, September 26, 2021

ভাবেন রবীন্দ্রনাথ ভাবান অন্যে ভাব টানে -চৌধুরী মনজুর লিয়াকত

‘এইতো তোমার আলোক ধেনু/সূর্য তারা দলে দলে/
কোথায় বসে বাজাও বেণু/চরাও মহা গগন তলে’।
রবীন্দ্রনাথ মহামহিমকে নিয়ে অনবরত চিন্তায় মগ্ন থেকেছেন। তাঁর ভাবনাকে জানতে পারা যায় তখনই, যখন এ নিয়ে একটু মন সংযোগে বিচরণ করা যায় সে অঙ্গনে। এক ঈশ্বর বিশ্বাসী রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকর্তার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের নিচের রচনাটি অসাধারণ এক অনুভ‚তি বয়ে নিয়ে আসে। প্রতিনিয়ত সৃষ্টিকর্তা সম্মুখে হচ্ছেন অবনত এখানে সেই চিরকালীন যাত্রার এক অংশ হিসেবেই
‘প্রতিদিন আমি, হে জীবনস্বামী,
দাঁড়াব তোমারি সম্মুখে।
করি জোড়কর, হে ভুবনেশ্বর,
দাঁড়াব তোমারি সম্মুখে।

তোমার অপার আকাশের তলে
বিজনে বিরলে হে,
নম্রহৃদয়ে নয়নের জলে
দাঁড়াব তোমারি সম্মুখে।

তোমার বিচিত্র এ ভবসংসারে
কর্ম পারাবার-পারে হে,
নিখিল-জগত-জনের মাঝারে
দাঁড়াব তোমারি সম্মুখে।

তোমার এ ভবে মোর কাজ যবে
সমাপন হবে হে,
ওগো রাজরাজ, একাকী নীরবে
দাঁড়াব তোমারি সম্মুখে।’

রবীন্দ্রনাথ মনের গহীনে ছিলেন ধার্মিক আর সত্যের সন্ধানী।
১৯৩২ সালে ‘পুনশ্চ’ কাব্যের শিশুতীর্থে সন্ধান করলেন আত্মার স্বরূপ। এভাবেই এগিয়ে যেতে যেতে গেয়ে ওঠেন-
‘সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর/ আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ তাই এত মধুর।’
একসময় লিখলেন ‘আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়েছিলে দেখতে আমি পাইনি তোমায়, দেখতে আমি পাই নি। বাহির পানে চোখ মেলেছি আমার হৃদয়-পানে চাই নি।’ এভাবেই নিজের মাঝে গুপ্ত আকাক্সক্ষার কথা উঠে আসে মহামহিম আবিষ্কারের বাসনায় নয়নে না ধরেও আঁখিপানে। দেখতে পাই স্রষ্টা আত্মনিবেদনে রচনা
‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে।
হৃদয় তোমারে পায় না জানিতে, হৃদয়ে রয়েছ গোপনে।
বাসনার বশে মন অবিরত ধায় দশ দিশে পাগলের মতো,
স্থির-আঁখি তুমি মরমে সতত জাগিছ শয়নে স্বপনে।
সবাই ছেড়েছে, নাই যার কেহ, তুমি আছ তার আছে তব স্নেহ
নিরাশ্রয় জন, পথ যার গেহ, সেও আছে তব ভবনে।
তুমি ছাড়া কেহ সাথী নাই আর, সমুখে অনন্ত জীবনবিস্তার
কালপারাবার করিতেছ পার কেহ নাহি জানে কেমনে।
জানি শুধু তুমি আছ তাই আছি, তুমি প্রাণময় তাই আমি বাঁচি,
যত পাই তোমায় আরো তত যাচি, যত জানি তত জানি নে।
জানি আমি তোমায় পাব নিরন্তর লোকলোকান্তরে যুগযুগান্তর
তুমি আর আমি মাঝে কেহ নাই, কোনো বাধা নাই ভুবনে।’
ধর্মীয় প্রাণের যোগাযোগ স্থাপনে ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, বারবার কেন পাই না’। এভাবে যেন অবলোকন করলেন তাঁকে-

‘কেন মেঘ আসে হৃদয় আকাশে
মোহ মেঘে তোমারে দেখিতে দেয় না মাঝে মাঝে তব দেখা পাই
চিরদিন কেন পাই না।
ক্ষণিক আলোকে আখির পলকে
তোমায় যবে পাই দেখিতে
ওহে হারাই হারাই সদা হয় ভয়
হারাইয়া ফেলি চকিতে
আর না মিটিতে হারাইয়া,
পলক না পড়িতে হারাইয়া,
হৃদয় না জুরাতে হারাইয়া ফেলি চকিতে।
ওহে কি করিলে বল পাইব তোমারে
রাখিব আঁখিতে আঁখিতে
ওহে এত প্রেম আমি কোথা পাব না
এত প্রেম আমি কোথা পাব না
তোমারে হৃদয়ে রাখিতে
আমার সাধ্য কিবা তোমারে,
দয়া না করিলে কে পারে,
তুমি আর নাই এলে এপারে হৃদয়ে রাখিতে।

ওহে আর কারো পানে চাহিব না আর
করিব এ আজি প্রাণপণ
ওহে তুমি যদি বল এখনি করিব
বিষয় বাসনা বিসর্জন
দিব শ্রীচরণে বিষয়,
দিব অকাতরে বিষয়,
দিব তোমার লাগি
বিষয় বাসনা বিসর্জন।

মাঝে মাঝে তব দেখা পাই
চিরদিন কেন পাই না।’
একটি সময় মগ্নচৈতন্যে প্রকট হয়ে উঠলো আধ্যাত্মিকতার নানা প্রশ্ন। উত্তর খুঁজলেন শান্তিনিকেতন উপদেশ মালায়।
শান্তিনিকেতনে যীশুখ্রিস্ট, শ্রীচৈতন্য, বুদ্ধ এবং হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর স্মরণসভা পালনের রীতি চালু করে বললেন, ‘আমি এখন আর নিসঃঙ্গ নই, সব ধর্মের সাধনার ধারা এবং মতবাদ বহন করে চলেছি।’
শান্তিনিকেতনের একটি স্থানে একটি নির্দিষ্ট উপাসনা গৃহ ছিল। যেখানে সকল ধর্মগুরুদের জীবন আর কর্ম নিয়ে আলোচনা হতো। তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে গান গাওয়া হতো। গৌতম বুদ্ধকে স্মরণ করা হতো ‘হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবীর মূর্ছনায়। যীশুখ্রিষ্টকে স্মরণ করতে গাওয়া হতো ‘এতদিন যারা মেরেছিল তাঁরে গিয়ে’। শিখ ধর্মগুরু নানকের জন্মদিনে গাওয়া হতো ‘গগনের থালে রবিচন্দ্র দীপক জ্বলে’।
আর হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্মদিনে স্মরণ করে গাওয়া হতো ‘কোন আলোতে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে তুমি ধরায় আসো।’ আর ‘আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে’ এই ভেবে খুঁজে বেড়িয়েছেন মনের মানুষকে। এখানে লালন ভাবিয়েছেন তাঁকে।
রাজা রামমোহন ১৮৩০ সালে ইংল্যান্ড চলে যান। আর এর তিন বছর পর মৃত্যুবরণ করেন। এই রাজা রামমোহনের ওপর প্রভাব পড়েছিল ‘মুতাজিলা বুদ্ধিবৃত্তির’। তাঁর মতে ‘মানুষের রয়েছে বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থ্য ও সংবেদনশীল শক্তি। তাই উচিত কাজ হলো, স্বগোত্রের দৃষ্টান্ত অনুসরণ না করে জ্ঞানের সাহায্যে ঈশ্বরের সন্ধান।’ এভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর আকৃষ্ট হন নিরাকার ঈশ্বরের সন্ধানে। এরপর তাঁর পিতা দেবেন্দ্রনাথ একই পথে। দুজনেই গ্রহণ করলেন ব্রাহ্ম ধর্ম। একসময় পিরালি ব্রাহ্মণ পরিবারের ধারায় অবশেষে একেশ্বরবাদী ধর্ম।
মূলত ঠাকুবাড়িতে সুফি চর্চা শুরু করেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি ছিলেন হাফিজের একনিষ্ঠ ভক্ত। জানা যায় ‘দেওয়ানে হাফিজ’ তার মুখস্থ ছিল। পাশাপাশি বেদ উপনিষদের চর্চা করতেন। আর মুসলিম চিন্তাধারার সাথে ঘনিষ্ঠ বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে ‘এক ঈশ্বর’ বিশ্বাস পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন সাধক মানুষ। শেখ সাদী এবং হাফিজসহ সুফি প্রভাব রবীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন উত্তরাধিকার সূত্রে। ১৯৩২ সালে হাফিজের সমাধিতে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর লেখা ‘পারস্যযাত্রী’তে সে কথা বলেছেন। ১৮ এপ্রিল ১৯৩২ হাফিজের সমাধিতে রবীন্দ্রনাথ। সমাধিরক্ষক হাফিজের লেখা একটি বই নিয়ে এলেন। কয়েকজন ইরানি পণ্ডিত ওই পাতার লেখা তর্জমা করলেন। রবীন্দ্রনাথও শুনতে চাইলেন হাফিজ সৃষ্টি থেকে। এ সময় একটি গজল পরিবেশন হয়। ইরানি কবি মুক্তাদিরের লেখা থেকে জানা যায় ‘রবীন্দ্রনাথ এমনভাবে কান পেতে ছিলেন, মনে হচ্ছিল যেন মোহগ্রস্ত হয়ে গেছেন তিনি। সিদ্ধি লাভকারী ধ্যানধারণা ঋষির মতো নিমগ্ন রবীন্দ্রনাথের দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল।’
সত্যিকার অর্থে রাজা রামমোহন বিলেত চলে না গেলে ইসলামের প্রভাব আরো খানিক পড়তো বৈকি রবীন্দ্রনাথ পরিবারের ওপর। এ যে বলা যায় নির্দ্বিধায়। রাজা রামমোহন ছিলেন ইসলাম ধর্মের দিকে ঝুঁকে থাকা এবং বেশ কিছুটা সুফিবাদে বিশ্বাসী। তাই রবীন্দ্রমানস গভীরে উপলব্ধিতে রামমোহন রায়কে জানা প্রয়োজন অতলে।
১৮৯১ থেকে ১৯০১ সাল পর্যন্ত অনেকগুলো প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। তার একটিতে অন্যের মতের প্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ বলেন
‘এমন সময়ে মুহাম্মদের আবির্ভাব হইল। সত্যলোকে স্বর্গরাজ্যের আসন্ন আগমন প্রচার করিয়া লোকসমাজে একটা হুলস্থুল বাধাইয়া দেওয়া তাঁহার উদ্দেশ্য ছিল না। সে সময়ে আরব সমাজে যে উচ্ছৃঙ্খলতা ছিল তাহাই যথাসম্ভব সংযত করিতে তিনি মনোনিবেশ করিলেন। পূর্বে বহুবিবাহ, দাসী সংসর্গ ও যথেচ্ছ স্ত্রী পরিত্যাগে কোনো বাধা ছিল না। তিনি তাহার সীমা নির্দিষ্ট করিয়া দিয়া স্ত্রীলোককে অপেক্ষাকৃত মান্য পদবীতে আরোপন করিলেন। তিনি বারবার বলিয়াছেন স্ত্রীবর্জন ঈশ্বরের চোখে নিতান্ত অপ্রিয় কার্য। কিন্তু এ প্রথা সমূলে উৎপাটিত করা কাহারও সাধ্যায়িত ছিল না। এজন্য স্ত্রীবর্জন একেবারে নিষেধ না করিয়া অনেকগুলো গুরুতর বাধার সৃষ্টি করিলেন।’ (প্রাচ্য সমাজ, সাধনা ১২৯৮)
এ প্রসঙ্গে বলি, রবীন্দ্রনাথের একটি লেখা ১৯৩৩ সালের ২৬ নভেম্বর ‘পয়গম্বর দিবস’ এর অনুষ্ঠানে পড়া হয়েছিল। পাঠ করেছিলেন কংগ্রেস নেত্রী সরোজিনী নাইডু। যেখানে সভাপতিত্ব করেছিলেন মির্জা আলি আকবর খাঁ। যা ছিল-
‘জগতে যে সামান্য কয়েকটি মহান ধর্ম আছে, ইসলাম তাদেরই অন্যতম। মহান এই ধর্মমতের অনুগামীদের দায়িত্বও তাই বিপুল। ইসলামপন্থীদের মনে রাখা দরকার, ধর্মবিশ্বাসের মহত্ব আর গভীরতা যেন তাঁদের প্রতিদিনের জীবনযাত্রার ওপরও ছাপ রেখে যায়। আসলে এই দুর্ভাগা দেশের অধিবাসী দুটি স¤প্রদায়ের বোঝাপড়া শুধু তো জাতীয় স্বার্থের সপ্রভিত উপলব্ধির ওপর নির্ভর করে না; সত্যদ্রষ্টাদের বাণীনিঃসৃত শাশ্বত প্রেরণার ওপরও তার নির্ভরতা। সত্য ও শাশ্বতকে যাঁরা জেনেছেন ও জানিয়েছেন, তাঁরা ঈশ্বরের ভালোবাসার পাত্র। এবং মানুষকেও তাঁরা চিরকাল ভালোবেসে এসেছেন।’
আরেকটি লেখা বেতারে স¤প্রচারিত হয়েছিল ২৫ জুন, ১৯৪৩ সালে, যা ছিল-
‘ইসলাম পৃথিবীর মহত্তম ধর্মের একটি। এই কারণে তার অনুবর্তিগনের দায়িত্ব অসীম, যেহেতু আপন জীবনে এই ধর্মের মহত্ব সম্বন্ধে তাঁদের সাক্ষ্য দিতে হবে। ভারতে যে-সকল বিভিন্ন ধর্মসমাজ আছে, তাদের কেবলমাত্র রাষ্ট্রিক স্বার্থবুদ্ধি দ্বারা তা সম্ভব হবে না, আমাদের নির্ভর করতে হবে সে অনুপ্রেরণার প্রতি, যা ঈশ্বরের প্রিয়পাত্র ও মানবের বন্ধু সত্যদূতদের অমর জীবন থেকে চির-উৎসারিত। আজকের এই পুণ্য অনুষ্ঠান উপলক্ষে মুসলিম ভাইদের সঙ্গে একযোগে ইসলামের মহাঋষির উদ্দেশ্যে আমার ভক্তি উপহার অর্পণ করে উৎপীড়িত, ভারতবর্ষের জন্য তাঁর আশীর্বাদ ও সান্ত¡না কামনা করি।’
রবীন্দ্রনাথ আরেকটি লেখা পাঠিয়েছিলেন নয়াদিল্লির জামে মসজিদ থেকে প্রকাশিত ‘পয়গম্বর’ সংখ্যার জন্য, যা ছিল ‘যিনি বিশ্বের মহত্তমদের অন্যতম, সেই পবিত্র পয়গম্বর হজরত মহম্মদের উদ্দেশে আমি আমার অন্তরের গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি। মানুষের ইতিহাসে এক নতুন, সম্ভাবনাময় জীবনীশক্তির সঞ্চার করেছিলেন পয়গম্বর হজরত, এনেছিলেন নিখাদ, শুদ্ধ ধর্মাচরণের আদর্শ। সর্বান্তঃকরণে প্রার্থনা করি, পবিত্র পয়গম্বরের প্রদর্শিত পথ যাঁরা অনুসরণ করছেন, আধুনিক। ভারতবর্ষের সুসভ্য ইতিহাস রচনা করে তাঁরা যেন জীবন সম্পর্কে তাঁদের গভীর আস্থা এবং পয়গম্বরের প্রদর্শিত প্রদত্ত শিক্ষাকে যথাযথ মর্যাদা দেন। তাঁরা যেন এমনভাবে ইতিহাসকে গড়ে তোলেন যাতে আমাদের জাতীয় জীবনে শান্তি ও পারস্পরিক শুভেচ্ছার বাতাবরণটি অটুট থেকে যায়।’
বলছেন এক জায়গায় ‘জগতে যেমন পিতাকে মাতাকে বন্ধুকে প্রিয়াকে পাইয়াছি তাহারা যেমন জগতের দিক হইতে ঈশ্বরের দিকে আমাকে কল্যাণসূত্রে বাঁধিতেছে তেমনি আমার জীবনের দেবতা আমার অতিজগতের সহচর একটি অপূর্ব নিত্য প্রেমের সূত্রে ঈশ্বরের সহিত আমার একটি পরম রহস্যময় আধ্যাত্মিক মিলনের সেতু রচনা করিতেছে। ঠিক বুঝাইলাম কি না জানি না, বলিতে গিয়া ভুল করিলাম কি না জানি না কিন্তু আমার কাব্যমেঘকে নানা স্থানেই বিচ্ছুরিত করিয়া এইরকমের কী একটা কথা বর্ণের রশ্মিতে আপনাকে প্রকাশ করিবার চেষ্টা করিয়াছে আমি তাহাকে ধরিয়া ফেলিবার চেষ্টায় উদয়াচল হাতড়াইয়া বেড়াইতেছি।’
এভাবেই বলছেন ‘জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ, ধন্য হলো ধন্য হলো মানবজীবন।’ এ জগৎ যে সৃষ্টিকর্তার আনন্দযজ্ঞ, এ আলোকে ভাবলেন তিনি সার্বিকতার এক ক্যানভাস চিত্রায়িত করে। সত্য আর সুন্দরের সন্ধানে মনে বেজে উঠেছে ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্য সুন্দরও’।
আর গীতবিতানে উচ্চারণ ‘তোমার আমার মিলন হবে বলে/আলোয় আকাশ ভরা। অন্য এক স্থানে বলছেন ‘জগৎমণ্ডলের জ্ঞানে ঈশ্বরের জ্ঞান, জগৎসৌন্দর্যের ভোগে ঈশ্বরের ভোগ এবং জগৎ সংসারের কর্মে ঈশ্বরের কর্ম।’
অনন্ত অসীম সকল সুখ ও জ্ঞানস্বরূপ যে সর্বশক্তিমান এই জগতের মূলে, তাঁর রহস্য উদঘাটনেও তাঁর আগ্রহের অভাব ছিল না কোনো দিনই। জানবার চেষ্টা করেছেন অকাতরে, সাধনা করেছেন তাঁর নৈকট্য ও করুণা লাভের। তাঁর এই সাধনায় প্রভাব ফেলেছে সুফিবাদ।
তাঁর দর্শন আর ধর্মতত্ত্বে জালালুদ্দিন রুমি মিলে যায়। যেখানে রুমি বলছেন- ‘যখন আমার মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হবে, আমার জন্য কেঁদো না। আমি তো চলে যাচ্ছি না, বরং আমি প্রবেশ করছি এক অন্তহীন ভালোবাসার জগতে, আমাকে কবরে নামিয়ে দিয়ে তোমরা বিদায় শব্দটা উচ্চারণ করো না।’ আর রবীন্দ্রনাথ বলছেন মৃত্যুভাবনায়- ‘আমারে তুমি অশেষ করেছ, এমন লীলা তব/ ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ জীবন নব নব।’
এভাবেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে তিনি নিজেকে আবিষ্কারের বিস্ময় চেতনায় বলে ওঠেন
‘আকাশ ভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ
তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি,
আমি পেয়েছি মোর স্থান,
বিস্ময়ে তাই জাগে, জাগে আমার গান।’
সেই কবে থেকে চলমান এক স্রোতের টানে এখনো তিনি টের পান আত্মীয়তা আর নাড়ির টান
‘অসীম কালের যে হিল্লোলে জোয়ার ভাঁটায় ভুবন দোলে
নাড়িতে মোর রক্তধারায় লেগেছে তার টান।
বিস্ময়ে তাই জাগে, জাগে আমার গান।’
সৃষ্টিকর্তার অমোঘ নিয়মের অপরূপ সৃষ্টিগুলোর সুতোয় বোনা ঘাস-ফুল আর সবুজের ঘ্রাণে তিনি বলেন
‘ঘাসে ঘাসে পা ফেলেছি বনের পথে যেতে
ফুলের গন্ধে চমক লেগে উঠেছে মন মেতে
ছড়িয়ে আছে আনন্দেরই দান।
বিস্ময়ে তাই জাগে, জাগে আমার গান।
কান পেতেছি, চোখ মেলেছি, ধরার বুকে প্রাণ ঢেলেছি,
জানার মাঝে অজানারে করেছি সন্ধান
বিস্ময়ে তাই জাগে, জাগে আমার গান।’
এভাবেই ভেবেছেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভাবের রাজ্যে আর ভালোবাসার ভেলায় ভাসালেন এবং ভাবালেন অসংখ্যে।

 https://www.bhorerkagoj.com/2019/06/03/%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%AC%E0%A7%87%E0%A6%A8-%E0%A6%B0%E0%A6%AC%E0%A7%80%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%A5-%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%A8/


 

No comments:

Post a Comment

Please validate CAPTCHA