ভূমিকা: বিজয় একটি চলমান দায়িত্ব
প্রতি বছর ১৬ ডিসেম্বর আমরা বাংলাদেশের বিজয় দিবস পালন করি। এটি কেবল একটি রাষ্ট্রীয় দিবস নয়; এটি হলো স্বাধীনতা, আত্মমর্যাদা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য ১৯৭১ সালে সংঘটিত ঐতিহাসিক সংগ্রামের স্মারক। বিজয় দিবস আমাদের অতীতের দিকে তাকাতে শেখায়, কিন্তু একই সঙ্গে বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য নৈতিক ও রাজনৈতিক দায়িত্বও স্মরণ করিয়ে দেয়।
বিজয় মানে শুধু শত্রুকে পরাজিত করা নয়; বিজয় মানে একটি রাষ্ট্র ও সমাজকে এমন পথে পরিচালিত করা, যেখানে মানুষ ভয় ছাড়া কথা বলতে পারে, ন্যায়বিচার পায় এবং সমান মর্যাদায় বাঁচতে পারে।
১৯৭১-এর চেতনা: স্বাধীনতার বাইরেও মুক্তির সংগ্রাম
মুক্তিযুদ্ধ কেবল ভৌগোলিক স্বাধীনতার যুদ্ধ ছিল না। এটি ছিল রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, রাজনৈতিক বঞ্চনা ও কাঠামোগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে একটি সর্বজনীন প্রতিরোধ আন্দোলন। ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, নারী, আদিবাসী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা—সবাই একত্রিত হয়েছিল এমন একটি বাংলাদেশের স্বপ্নে, যেখানে পরিচয়, মত বা বিশ্বাসের কারণে কেউ নির্যাতিত হবে না।
১৯৭১-এর বিজয়ের অন্তর্নিহিত অর্থ ছিল—
-
ভয়মুক্ত জীবন
-
আইনের সামনে সকলের সমতা
-
গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা
-
সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা
-
ক্ষমতার জবাবদিহিতা
এই মূল্যবোধগুলো ছাড়া বিজয় কেবল একটি আনুষ্ঠানিক শব্দে পরিণত হয়।
রাষ্ট্রীয় সহিংসতা: বিজয়ের চেতনার পরিপন্থী বাস্তবতা
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সবচেয়ে বেদনাদায়ক বাস্তবতাগুলোর একটি হলো রাষ্ট্রীয় সহিংসতার ধারাবাহিকতা। বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, হেফাজতে নির্যাতন এবং মতপ্রকাশের ওপর দমনমূলক আচরণ—এসবই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের সরাসরি বিরোধী।
যে রাষ্ট্র নিপীড়নের বিরুদ্ধে জন্ম নিয়েছিল, সেই রাষ্ট্র কখনোই নিপীড়নকে শাসনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে না। যখন নাগরিকরা নিরাপত্তা বাহিনীকেই ভয় পায়, তখন বিজয়ের নৈতিক ভিত্তি ভেঙে পড়ে।
রাষ্ট্রীয় সহিংসতার অবসান ছাড়া বিজয়ের পূর্ণতা সম্ভব নয়।
রাজনৈতিক অধিকার ও গণতন্ত্র: মুক্তিযুদ্ধের কেন্দ্রীয় দাবি
মুক্তিযুদ্ধের মূল প্রেরণা ছিল রাজনৈতিক অধিকার ও জনগণের আত্মশাসনের অধিকার। কিন্তু গণতন্ত্র তখনই দুর্বল হয়, যখন নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়, বিরোধী কণ্ঠ দমন করা হয় এবং নাগরিক পরিসর সংকুচিত হয়।
একটি রাষ্ট্র তখনই বিজয়ের দাবি করতে পারে, যখন—
-
নির্বাচন হয় অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক
-
মতপ্রকাশ ও সংগঠনের স্বাধীনতা নিশ্চিত থাকে
-
বিরোধী রাজনীতি রাষ্ট্রদ্রোহ হিসেবে চিহ্নিত না হয়
-
বিচার বিভাগ ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান স্বাধীন থাকে
গণতন্ত্র রাষ্ট্রের শত্রু নয়; গণতন্ত্রই রাষ্ট্রের বৈধতা।
ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার: জাতীয় নৈতিকতার পরীক্ষা
বাংলাদেশের সমাজ ঐতিহাসিকভাবে বহুত্ববাদী। কিন্তু ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতা, দখল, বৈষম্য ও অব্যাহত নিরাপত্তাহীনতা আমাদের জাতীয় নৈতিকতার ওপর প্রশ্ন তোলে।
যে দেশে বিশ্বাসের কারণে মানুষ ভীত থাকে, সেই দেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে যথাযথভাবে ধারণ করতে পারে না। সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা কোনো দয়া নয়; এটি একটি সাংবিধানিক দায়িত্ব এবং মানবিক বাধ্যবাধকতা।
গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা: বিজয়ের নিরাপত্তাবলয়
জবাবদিহিতা ছাড়া ক্ষমতা স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ও ক্ষমতাধর ব্যক্তি জনগণের কাছে দায়বদ্ধ।
স্বচ্ছতা, আইনের শাসন ও প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণই হলো বিজয়কে টিকিয়ে রাখার প্রকৃত নিরাপত্তাবলয়। ১৯৭১ আমাদের শিখিয়েছে—কোনো ক্ষমতাই জনগণের ঊর্ধ্বে নয়।
উপসংহার: ১৯৭১-এর বিজয়কে সম্পূর্ণ করার আহ্বান
বিজয় দিবস ২০২৫ আমাদের কাছে একটি প্রশ্ন ছুড়ে দেয়—আমরা কি কেবল স্মরণ করব, নাকি দায়িত্ব গ্রহণ করব?
বিজয় তখনই পূর্ণতা পায়, যখন বাংলাদেশ হয়ে ওঠে—
-
কর্তৃত্ববাদী নয়, গণতান্ত্রিক
-
সহিংস নয়, মানবিক
-
বৈষম্যমূলক নয়, অন্তর্ভুক্তিমূলক
-
স্বেচ্ছাচারী নয়, জবাবদিহিমূলক
এই লক্ষ্য অর্জনই হবে ১৯৭১-এর শহীদদের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা।
উপস্থাপনায়-
মিনহাজ সামাদ চৌধুরী
Independent Human Rights Defender
🌐 https://hr-defender.blogspot.com
ফোকাস:
রাষ্ট্রীয় সহিংসতা • রাজনৈতিক অধিকার •
ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার •
বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা


No comments:
Post a Comment
Please validate CAPTCHA