বিজয় মানে কেবল বহিঃশত্রুর পরাজয় নয়। বিজয় মানে স্বাধীনতার উপস্থিতি।
স্বাধীনতার পাঁচ দশকেরও বেশি সময় পর বাংলাদেশ একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র—আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত, ভৌগোলিকভাবে নিরাপদ। কিন্তু একটি মৌলিক প্রশ্ন আজও অমীমাংসিত রয়ে গেছে: যে স্বাধীনতার জন্য এত প্রাণ গেল, তা কি আমরা পুরোপুরি অর্জন করতে পেরেছি? যদি রাষ্ট্র ভিন্নমতকে ভয় পায়, তবে সেই প্রশ্নের উত্তর সৎভাবে দিতে হবে।
ভিন্নমতকে ভয় পাওয়া একটি বাংলাদেশ—স্বাধীন হলেও—এখনও পুরোপুরি বিজয়ী নয়। স্বাধীনতার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন নেই; প্রশ্ন হলো মুক্তির পরিপূর্ণতা নিয়ে।
স্বাধীনতা আছে, কিন্তু মুক্তি কি আছে?
১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ কেবল ভূখণ্ডের জন্য ছিল না; এটি ছিল রাজনৈতিক বঞ্চনা, সাংস্কৃতিক অবদমন ও কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে এক ঐতিহাসিক বিদ্রোহ। মানুষের কণ্ঠস্বর অস্বীকার করা হয়েছিল বলেই মানুষ বিদ্রোহে নেমেছিল। ভিন্নমত ছিল না কোনো পার্শ্বঘটনা—ভিন্নমতই ছিল মুক্তির চালিকাশক্তি।
আজ যদি রাষ্ট্র ভিন্নমতকে ভয় পায়, তবে তা নিজের জন্মকারণকেই ভয় পাওয়া।
যখন সমালোচনাকে ষড়যন্ত্র বলা হয়,
যখন শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকে অরাজকতা হিসেবে দেখা হয়,
যখন সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীরা হয়রানির শিকার হন—
তখন রাষ্ট্র একটি ভয়াবহ বৈপরীত্যে আটকে পড়ে:
যে প্রতিরোধ দিয়ে স্বাধীনতা এসেছে, সেই প্রতিরোধই আজ অপরাধ।
ভিন্নমত রাষ্ট্রের আত্মবিশ্বাসের মাপকাঠি
একটি আত্মবিশ্বাসী রাষ্ট্র ভিন্নমতকে দেশদ্রোহ মনে করে না। বরং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র জানে—ভিন্নমত মানে নাগরিকেরা এখনো রাষ্ট্রকে নিজের মনে করে, প্রশ্ন করার অধিকার দাবি করে।
ভিন্নমতকে ভয় পাওয়া মানে হলো ক্ষমতার ভেতরের অনিশ্চয়তা।
ইতিহাস বলে, যে রাষ্ট্র ভিন্নমত দমন করে, সে রাষ্ট্র সাময়িক ‘স্থিতিশীলতা’ দেখাতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তৈরি করে নীরব ক্ষোভ। এই নীরবতা শান্ত নয়; এটি ভঙ্গুর।
নীরবতার ওপর দাঁড়ানো বিজয় কখনোই টেকসই নয়।
দেশপ্রেম বনাম অন্ধ আনুগত্য
সমসাময়িক রাজনৈতিক সংস্কৃতির সবচেয়ে বিপজ্জনক বিভ্রান্তি হলো দেশপ্রেমকে অন্ধ আনুগত্যের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা। নীতির সমালোচনা, দুর্নীতি উন্মোচন কিংবা সংখ্যালঘু অধিকার রক্ষার চেষ্টা—সবকিছুকেই প্রায়ই ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ বলে চিহ্নিত করা হয়।
কিন্তু ইতিহাস ভিন্ন কথা বলে।
১৯৭১ সালে দেশপ্রেম মানে ছিল অবাধ্যতা।
অন্যায়ের কাছে মাথা না নোয়ানো।
নীরব থাকাই যখন নিরাপদ, তখন কথা বলা।
এই মানদণ্ডে ভিন্নমত পোষণকারী নাগরিক রাষ্ট্রের শত্রু নয়; বরং তারা মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতা।
সংখ্যালঘু কণ্ঠস্বর ও অসম্পূর্ণ বিজয়
ভিন্নমত দমনের সবচেয়ে বড় মূল্য দিতে হয় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীগুলোকে—ধর্মীয় সংখ্যালঘু, জাতিগত সম্প্রদায়, রাজনৈতিক বিরোধী কণ্ঠ এবং মানবাধিকারকর্মীদের।
তাদের অভিযোগকে প্রায়ই ‘অস্বস্তিকর’, ‘রাজনৈতিক’ বা ‘অতিরঞ্জিত’ বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়।
কিন্তু যে বিজয় সবচেয়ে দুর্বল নাগরিককে নিরাপত্তা দিতে পারে না, সেই বিজয় নৈতিকভাবে অসম্পূর্ণ।
সংখ্যালঘুদের নীরবতা দিয়ে গড়া ঐক্য আসলে ঐক্য নয়—তা বর্জন।
বিজয়: একটি জীবন্ত দায়িত্ব
বিজয় কোনো বার্ষিক উৎসবের ট্রফি নয়।
এটি একটি চলমান দায়িত্ব।
এর জন্য প্রয়োজন যুদ্ধক্ষেত্রের সাহস নয় শুধু, প্রয়োজন শাসনে ন্যায়, আইনে সমতা, এবং রাষ্ট্রীয় আচরণে সংযম।
ডিসেম্বর তাই শুধু স্মরণের মাস নয়; এটি হওয়া উচিত আত্মসমালোচনার সময়।
যদি কথা বলার জায়গা সংকুচিত হয়,
যদি জবাবদিহিকে শত্রুতা হিসেবে দেখা হয়,
যদি ভিন্নমতকে ঝুঁকি ধরা হয়—
তবে স্বাধীনতা থাকলেও মুক্তি নেই।
সম্পূর্ণ বিজয়ের পথে
একটি সত্যিকারের বিজয়ী বাংলাদেশ ভিন্নমতকে ভয় পাবে না; বরং ভিন্নমতের ওপর নির্ভর করবে। কারণ ভিন্নমত মানে রাষ্ট্রের প্রতি যত্ন, প্রতিবাদ মানে অন্তর্ভুক্তির দাবি, আর জবাবদিহি মানে গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতা।
একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র গল্প নিয়ন্ত্রণে নয়, নাগরিকের ওপর আস্থায় শক্তিশালী হয়।
যতদিন বাংলাদেশ ভিন্নমতকে ভয় পাবে, ততদিন তার বিজয় সম্মানজনক হলেও অসম্পূর্ণই থেকে যাবে।
এই বিজয় পূর্ণতা পাবে তখনই,
যখন স্বাধীনতা আর ভয়ের মুখোমুখি দাঁড়াবে না।
উপস্থাপনায়
মিনহাজ সামাদ চৌধুরী
স্বাধীন মানবাধিকার কর্মী
🌐 https://hr-defender.blogspot.com
ফোকাস: রাষ্ট্রীয় সহিংসতা • রাজনৈতিক অধিকার • ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার • গণতান্ত্রিক জবাবদিহি


No comments:
Post a Comment
Please validate CAPTCHA