খালেদা জিয়ার উত্তরাধিকার ও বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম - Bangladesh HR Defender | Human Rights, Rule of Law & Accountability

Latest

Wednesday, December 31, 2025

খালেদা জিয়ার উত্তরাধিকার ও বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম

 



বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার সঙ্গে খালেদা জিয়া–এর রাজনৈতিক উত্তরাধিকার অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। তাঁর জীবন ও কর্ম দেশের বেসামরিক শাসন, নির্বাচনী বৈধতা এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সীমা নির্ধারণ–সংক্রান্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লড়াইগুলোর সঙ্গে সমান্তরালে বিকশিত হয়েছে। তাঁর উত্তরাধিকার মূল্যায়ন মানে কেবল একজন রাজনৈতিক নেতার উত্থান-পতন নয়; বরং বাংলাদেশের গণতন্ত্র কীভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, সংকুচিত হয়েছে এবং বারবার নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত হয়েছে—তা বিশ্লেষণ করা।

খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উত্থান ছিল না প্রচলিত বা পরিকল্পিত। ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর তিনি জনজীবনে প্রবেশ করেন—এক সময়ে, যখন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ভঙ্গুর ছিল এবং কর্তৃত্ববাদী দখলের ঝুঁকিতে ছিল। ব্যক্তিগত জীবন থেকে রাজনীতিতে তাঁর প্রবেশ ছিল উচ্চাকাঙ্ক্ষার চেয়ে ঐতিহাসিক সংকটের প্রতিক্রিয়া—রাষ্ট্রীয় অস্থিরতার মধ্যে নাগরিক নেতৃত্বের ধারাবাহিকতার এক দাবি।

প্রতিরোধ ও বেসামরিক শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা

খালেদা জিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক অবদান নিহিত রয়েছে ১৯৮০–এর দশকে, যখন বাংলাদেশ সামরিক শাসনের অধীনে ছিল। এরশাদ শাসনামলে বিরোধী নেত্রী হিসেবে তিনি কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নেন। বারবার গ্রেপ্তার, রাজনৈতিক হয়রানি ও নাগরিক পরিসর সংকুচিত হওয়ার মধ্যেও তিনি সামরিক শাসনের বৈধতা অস্বীকার করে যান।

১৯৯০ সালে সামরিক শাসনের পতনে ভূমিকা রাখা গণআন্দোলনে তাঁর অংশগ্রহণ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে এক মাইলফলক। এই রূপান্তর নির্বাচনী রাজনীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে এবং বেসামরিক কর্তৃত্বের নীতিকে পুনরায় স্বীকৃতি দেয়। মানবাধিকার দৃষ্টিকোণ থেকে এই অধ্যায় প্রমাণ করে—দমনমূলক বাস্তবতায় সম্মিলিত প্রতিরোধ রাজনৈতিক অধিকার পুনরুদ্ধারের শক্তিশালী মাধ্যম।

শাসন, সংস্কার ও গণতান্ত্রিক দ্বন্দ্ব

১৯৯১ সালে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে খালেদা জিয়া সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের নেতৃত্ব দেন। সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে নির্বাহী ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ হ্রাস পায় এবং সংসদীয় জবাবদিহি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন নির্বাচন পরিচালনায় নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা হিসেবে ব্যাপক সমর্থন পায়—যা দলীয় তত্ত্বাবধানে জনআস্থাহীনতার প্রতিক্রিয়া ছিল।

তাঁর সরকারগুলো অর্থনৈতিক উদারীকরণ ও সামাজিক উদ্যোগ গ্রহণ করে; বিশেষ করে গ্রামীণ মেয়েদের শিক্ষায় প্রবেশাধিকার সম্প্রসারণ দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন প্রভাব ফেলে। এসব উদ্যোগ গণতন্ত্রকে সামাজিকভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক করার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে।

তবে একই সময়ে রাজনৈতিক মেরুকরণ তীব্র হয়। প্রধান দুই রাজনৈতিক ধারার দীর্ঘস্থায়ী প্রতিদ্বন্দ্বিতা ‘উইনার-টেকস-অল’ সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করে—যা সংসদীয় রীতিনীতি দুর্বল করে, ভিন্নমতকে প্রান্তিক করে এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংঘাতকে স্বাভাবিক করে তোলে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সচল থাকলেও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়।

এই দ্বন্দ্ব—প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র ও সংকুচিত রাজনৈতিক সহনশীলতার মধ্যে—পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের গভীর গণতান্ত্রিক সংকটকে সংজ্ঞায়িত করে।

নিপীড়ন, রাজনৈতিক অধিকার ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা

খালেদা জিয়ার জীবনের শেষ পর্যায় বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যর্থতার সবচেয়ে স্পষ্ট দৃষ্টান্ত। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে ব্যাপকভাবে বিবেচিত দুর্নীতির মামলায় তাঁর কারাবাস আইনি প্রক্রিয়া, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং মানবিক আচরণ নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তোলে। দীর্ঘ কারাবাস, সীমিত চিকিৎসা সুবিধা এবং কার্যত রাজনৈতিক বহিষ্কার—একজন সাবেক সরকারপ্রধানকে বিরোধী নিপীড়নের প্রতীকে পরিণত করে।

মানবাধিকার দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁর অভিজ্ঞতা একটি গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতা দেয়: আইন ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান যখন নির্বাচনীভাবে ব্যবহৃত হয়, তখন জবাবদিহি তার বৈধতা হারায় এবং গণতন্ত্র নিজেই দুর্বল হয়ে পড়ে। তাঁর নিপীড়ন ছিল কেবল ব্যক্তিগত নয়; বরং নাগরিক পরিসর সংকোচন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হ্রাস এবং রাজনৈতিক বহুত্ববাদে অসহিষ্ণুতার বৃহত্তর প্রবণতার প্রতিফলন।

দমন-পরবর্তী সংযম

রাজনৈতিক উত্থান-পতনের পর মুক্তি পাওয়ার পর খালেদা জিয়ার প্রকাশ্য অবস্থান ছিল লক্ষণীয়ভাবে সংযত। প্রতিশোধের আহ্বান না জানিয়ে তিনি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও পুনর্মিলনের কথা বলেন। দীর্ঘ নিপীড়নের পর এই অবস্থান নৈতিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে—যা বাংলাদেশের প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনৈতিক চর্চার বিপরীতে দাঁড়ায়।

মানবাধিকার কর্মীদের জন্য এই মুহূর্তটি তাৎপর্যপূর্ণ। এটি দেখায়—গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের মানদণ্ড কেবল অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে নয়; বরং অন্যায়ের পর সংযমে।

উত্তরাধিকার ও গণতান্ত্রিক শিক্ষা

খালেদা জিয়ার উত্তরাধিকার সহজ সিদ্ধান্তে আবদ্ধ নয়। তিনি একদিকে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের রক্ষক; অন্যদিকে এমন এক রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ, যা পরবর্তীতে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করেছে। তিনি ইতিহাসের এক পর্যায়ে প্রতিরোধের প্রতীক, আর অন্য পর্যায়ে দমনের শিকার। তাঁর জীবন তাই বাংলাদেশের গণতন্ত্রের বৈপরীত্য—তার স্থিতিস্থাপকতা ও ভঙ্গুরতা—উভয়ই প্রতিফলিত করে।

এই উত্তরাধিকার বাংলাদেশকে কয়েকটি মৌলিক প্রশ্নের মুখোমুখি করে:

  • ক্ষমতায় কে আছে তা নির্বিশেষে কি রাজনৈতিক অধিকার সুরক্ষিত থাকবে?

  • জবাবদিহি কি রাজনৈতিক বহিষ্কারের হাতিয়ার না হয়ে কার্যকর করা সম্ভব?

  • ব্যক্তিকেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব ছাড়িয়ে কি প্রতিষ্ঠানভিত্তিক অখণ্ডতায় গণতন্ত্র পরিণত হতে পারবে?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তরই নির্ধারণ করবে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম গণতান্ত্রিক সংহতিতে রূপ নেবে কি না।

উপসংহার

খালেদা জিয়ার জীবন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির সম্ভাবনা ও বিপদের সাক্ষ্য বহন করে। প্রতিরোধের নেত্রী থেকে শাসনক্ষমতার কেন্দ্র, এবং সেখান থেকে রাজনৈতিক বন্দি—এই পূর্ণ বৃত্তটি গণতান্ত্রিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার সব রূপকে ধারণ করে।

গণতন্ত্র কেবল নির্বাচন দিয়ে টিকে থাকে না। এটি টিকে থাকে ভিন্নমতের সুরক্ষা, প্রাতিষ্ঠানিক নিরপেক্ষতা এবং সব রাজনৈতিক পক্ষের মর্যাদা রক্ষার মাধ্যমে। যদি খালেদা জিয়ার জীবন ও ভোগান্তি এই নীতিগুলোর প্রতি নতুন করে অঙ্গীকার জাগিয়ে তোলে, তবে তাঁর উত্তরাধিকার দলীয় স্মৃতির সীমা ছাড়িয়ে জাতির গণতান্ত্রিক বিবেকের অংশ হয়ে থাকবে।


উপস্থাপনায়: মিনহাজ সামাদ চৌধুরী
স্বাধীন মানবাধিকার কর্মী ও নীতিনির্ধারণ বিশ্লেষক
কেন্দ্রীয় ক্ষেত্রসমূহ: রাষ্ট্রীয় সহিংসতা • গণমাধ্যমের স্বাধীনতা • রাজনৈতিক অধিকার • সংখ্যালঘু সুরক্ষা • গণতান্ত্রিক জবাবদিহি

No comments:

Post a Comment

Please validate CAPTCHA