আমায় ক্ষমা কর পিতা : শেষ পর্ব
'নির্লজ্জ বেহায়া হতেই কী আমরা তোমাকে খুন করেছি কিংবা তোমাকে রক্ষা করিনি?'
প্রবীর সিকদার
১৫
আগস্ট ১৯৭৫। ভোর ৬ টা ১ মিনিট। রেডিওতে ভেসে এলো সর্বকালের ভয়ংকর
দুঃসংবাদ! 'আমি মেজর ডালিম বলছি, স্বৈরাচারী শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে।'
কথায় বলে, অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর। খুনি মেজর ডালিমের হৃদস্পন্দন
থামিয়ে দেওয়া সেই ভয়ংকর ঘোষণায় পুরো বাংলাদেশ যেন পাথর হয়ে যায়! কিছু
শকুনের উল্লাস ছাড়া কোথাও কোনও সাড়া শব্দ নেই। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলায়
দুলতে দুলতে যখন খুনি ডালিমের ঘোষণাটি সারা পৃথিবীর একটি হৃদয় বিদারক খবরে
পরিণত হয়, তখন বাংলাদেশ হারিয়ে ফেলে তার হৃদস্পন্দন। এ কী খবর শুনছে
বাংলাদেশ! পাকিস্তানি হায়েনারা ৩০ লাখ বাঙালি খুন করলেও বঙ্গন্ধুকে হত্যার
সাহস পায়নি। এরা কোন কুলাঙ্গার বাঙালি, যারা এই জঘন্য কাজটি করলো!
বাংলাদেশকে 'মিনি পাকিস্তান'-এর মোড়কে ঢুকিয়ে একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয় ওরা! আর আমরা! সংকীর্ণ কিংবা দাপটে টিকে থাকার লড়াইয়ে নেমে মুক্তিযোদ্ধা-রাজাকার একাকার হয়ে যাই! অলিখিত নির্দেশে নিষিদ্ধ হয়ে যায় জয়বাংলা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা! নিষিদ্ধ হয়ে যায় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারও! অভিনব এক জাতীয় দর্শনের প্রবক্তা হয়ে যান বঙ্গবন্ধু খুনের সরাসরি বেনিফিসিয়ারি জেনারেল জিয়া! ১৯৭১ এ অর্জিত বাংলাদেশের চাকা পঁচাত্তরে আবার দ্রুতই ঘুরতে থাকে উল্টো দিকে। জিন্দাবাদে ভরে যায় দেশ! আমরা সবাই 'নষ্ট' হয়েই রক্ষা করি নিজেদেরকে!
কথায় কথায় অনেকেই বলেন, স্বাধীনতার ৪৫ বছর কেটে গেল! কি পেলাম আমরা! অথচ আমরা বেমালুম ভুলে যাই, ১৯৭১ এর পর বাংলাদেশে একটি ভয়ংকর ১৯৭৫ এসেছিল! ১৯৭৫ শুধু জাতির পিতাকেই খুন করেনি, খুন করেছে জাতির আশা আকাঙ্ক্ষা সম্ভাবনাকেও! বঙ্গবন্ধু মুজিব খুন না হলে একাত্তরের বাংলাদেশ আজ কোথায় যেতো, এ হিসেব করতে আমরা ভুলে যাই! সর্বকালের সেরা বাঙালি একজন বিশ্বনেতাকে খুন করে আমরা যেন এখনো অনুতপ্ত নই!
পিতা! অনেক বিলম্বে হলেও আমরা তোমার খুনিদের ফাঁসিতে ঝুলিয়েছি। এখনো পালিয়ে বেঁচে আছে কয়েক খুনি। হয়তো ওরাও ঝুলবে। একাত্তরের ঘাতকদের যে বিচার প্রক্রিয়া তুমি শুরু করেছিলে, পঁচাত্তরে তোমাকে খুনের পর সেটি হারিয়েছিল পথ। আমরা একাত্তরের ঘাতকদেরও ফাঁসির দড়িতে ঝোলানো শুরু করেছি। আমাদের কাণ্ডারি তোমারই রক্তের যোগ্য উত্তরসূরি শেখ হাসিনা। আমরা ছাড়ছি না তাকে! তোমার অসমাপ্ত কাজ তো তাকেই শেষ করতে হবে!
পিতা! তোমাকে হারানোর পর আমরা বড় বেশি নষ্ট হয়ে গেছি! তোমার বিরুদ্ধ স্রোতের রাষ্ট্রযন্ত্র আমাদেরকে প্রলুব্ধ করে এই সর্বনাশটি করেছে। আমরা সুযোগ পেলেই নিজেদেরকে তোমার উত্তরসূরি বলে দাবি করি! কিন্তু তোমার জীবন দর্শন মেনে চলি না! তোমার বিশাল কর্মযজ্ঞের কোনও কৌশলই আমরা রপ্ত করি না! মুখে বেশ জোরেশোরেই 'জয় বাংলা' বলি। আর একই সঙ্গে তোমার খুনিদের ইচ্ছায় গড়ে ওঠা 'জিন্দাবাদ'-এর বলয়ের সাথে গোপন কিংবা প্রকাশ্য আঁতাত করে পথ চলি! আমি নিশ্চিত করেই জানি, তোমার আদর্শিক বলয় এতোটাই সুদৃঢ় যে, নষ্ট রাজনীতির ওই বৃত্ত একদিন হারিয়ে যাবেই। তারপরও আঁতাতের ওই অপরাজনীতির অভ্যাস ত্যাগ করতে পারিনি। অন্ধকারের নানা ঝামেলা সামাল দেয়ার জন্য আঁতাত বুঝি খুবই জরুরি! আর এই নির্লজ্জ বেহায়া হতেই কী আমরা তোমাকে খুন করেছি কিংবা তোমাকে রক্ষা করিনি? কী অকৃতজ্ঞ, কী কৃতঘ্ন সন্তান আমি!
পিতা, আমায় ক্ষমা কর তুমি, ক্ষমা কর।
Endless gratified thanks for reading / watching /listening
No comments:
Post a Comment
Please validate CAPTCHA