মব-উৎসবের আগুনে রাষ্ট্র পুড়ছে: দুষ্টের লালন, শিষ্টের দমন—বাংলাদেশ কোন পথে? - Bangladesh HR Defender | Human Rights, Rule of Law & Accountability

Latest

Tuesday, December 23, 2025

মব-উৎসবের আগুনে রাষ্ট্র পুড়ছে: দুষ্টের লালন, শিষ্টের দমন—বাংলাদেশ কোন পথে?

 


বাংলাদেশ আজ এক গভীরভাবে অস্বস্তিকর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। সহিংসতা আর কেবল রাজনৈতিক সংকটের মুহূর্তে বিস্ফোরিত হচ্ছে না; বরং তা ক্রমশ পরিকল্পিতভাবে মঞ্চস্থ, স্বাভাবিকীকৃত এবং অনেক ক্ষেত্রে উদ্‌যাপিত হয়ে উঠছে—জনসমাবেশ, জনআবেগ কিংবা তথাকথিত “উৎসবমুখর” আয়োজনের আড়ালে।

যা একসময় ছিল বিচ্ছিন্ন ও আকস্মিক অস্থিরতা, তা এখন রূপ নিচ্ছে একটি পুনরাবৃত্ত বাস্তবতায়—সংগঠিত মব সহিংসতার জনসমক্ষে প্রদর্শনীতে

এই সহিংসতার চেয়েও বেশি উদ্বেগজনক বিষয় হলো, এর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের দৃঢ় ও তাৎক্ষণিক প্রতিরোধের অভাব। যখন ধ্বংসযজ্ঞ আগাম ঘোষণা দিয়ে সংঘটিত হয়, প্রকাশ্যে সম্পন্ন হয়, এবং বারবার ঘটেও কার্যকর জবাবদিহি সৃষ্টি করে না—তখন প্রশ্নটি আর শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষার সক্ষমতা নিয়ে থাকে না; প্রশ্ন উঠে যায় রাষ্ট্রের নৈতিক অবস্থান নিয়ে।

এটি আর বিচ্ছিন্ন আইনশৃঙ্খলা ব্যর্থতার প্রশ্ন নয়। এটি শাসনব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় বৈধতা এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পথনির্দেশের প্রশ্ন।


১. “মব-উৎসব”-এর উত্থান: যখন সহিংসতা হয়ে ওঠে প্রদর্শনী

দক্ষিণ এশিয়ায় মব সহিংসতা নতুন কিছু নয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে যে বিষয়টি নতুনভাবে চোখে পড়ছে, তা হলো এর আনুষ্ঠানিকীকরণ ও সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা

গত কয়েক বছরে দেখা গেছে, অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও শারীরিক সহিংসতা ক্রমেই সংঘটিত হচ্ছে—

  • আগাম ঘোষণা বা উসকানির পর

  • উল্লসিত বা নীরব দর্শক জনতার উপস্থিতিতে

  • রাজনৈতিক প্রতীক বা সামষ্টিক আবেগের আড়ালে

  • এবং যথাযথ ও তাৎক্ষণিক রাষ্ট্রীয় প্রতিক্রিয়া ছাড়াই

এই পরিস্থিতিতে সহিংসতা আর নিছক অপরাধ থাকে না। তা হয়ে ওঠে ক্ষমতার প্রদর্শনী—যেন আইন স্থগিত করা যায়, সংখ্যাই ন্যায়বিচারের বিকল্প, আর ভয়ই অধিকারের চেয়ে শক্তিশালী।

যখন মব গোপনে নয়, আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কাজ করে, তখন তা হঠাৎ আবেগ নয়—বরং দায়মুক্তির প্রত্যাশার প্রতিফলন। আর দায়মুক্তি একবার স্বাভাবিক হয়ে গেলে, তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বিভিন্ন ঘটনায় দেখা গেছে, রাজনৈতিকভাবে উত্তেজনাকর ঘটনার পর মব দ্বারা গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায় লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। হুমকি দেওয়া হয়েছে আগাম, লক্ষ্য নির্ধারিত হয়েছে প্রকাশ্যে, অথচ কার্যকর প্রতিরোধ অনুপস্থিত থেকেছে। এসব ঘটনা সহিংসতাকে ব্যতিক্রম নয়, বরং প্রদর্শনীতে রূপ নেওয়ার প্রবণতা স্পষ্ট করে।

২. “দুষ্টের লালন, শিষ্টের দমন”: এক গভীর শাসনগত ব্যাধি

“দুষ্টের লালন, শিষ্টের দমন”—এই বাক্যটি আজ কেবল প্রবাদ নয়; এটি একটি পরিচিত শাসনগত ব্যর্থতার সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞা। এমন পরিস্থিতিতে দেখা যায়—

  • অপরাধীরা কার্যত দায়মুক্তি পায়

  • সহিংসতার পরিকল্পনাকারী ও উসকানিদাতারা অচিহ্নিত থাকে

  • সাংবাদিক, সংখ্যালঘু, সংস্কৃতিকর্মী ও সচেতন নাগরিকরা নিরাপত্তাহীন বোধ করেন

  • আইন মানা ও সংযমকে দুর্বলতা হিসেবে দেখা হয়

এই পরিবেশে সামাজিক মানদণ্ড উল্টে যায়। সহিংসতা হয়ে ওঠে দৃশ্যমানতা ও প্রভাব অর্জনের হাতিয়ার, আর নাগরিক দায়িত্ব হয়ে পড়ে ঝুঁকিপূর্ণ।

ফলাফল কেবল নিরাপত্তাহীনতা নয়, বরং নৈতিক ক্ষয়। মানুষ যখন বিশ্বাস করতে শুরু করে যে অন্যায় করলে সুরক্ষা মেলে, আর সৎ থাকলে বিপদ বাড়ে—তখন রাষ্ট্র ও নাগরিকের মধ্যকার সামাজিক চুক্তি ভেঙে পড়তে শুরু করে। বর্তমান অন্তর্বর্তী শাসনব্যবস্থার অধীনে সংখ্যালঘু ও স্বাধীন কণ্ঠস্বরের ওপর হামলা যথাযথভাবে মোকাবিলা না হওয়ায় এই ভয় ও নীরবতার সংস্কৃতি আরও গভীর হচ্ছে—এমন উদ্বেগ বহু মহলে প্রকাশ পেয়েছে।

৩. রাষ্ট্রীয় নীরবতা: অক্ষমতা, হিসাব, না কি কৌশলগত সহনশীলতা?

সহিংসতার মুখে রাষ্ট্রের নীরবতা কখনোই নিরপেক্ষ নয়। এর পেছনে ভিন্ন ভিন্ন কারণ থাকতে পারে, কিন্তু পরিণতি একটাই—রাষ্ট্রীয় বৈধতার ক্ষয়

  • প্রাতিষ্ঠানিক অক্ষমতা: দুর্বল সমন্বয়, গোয়েন্দা ঘাটতি বা অতিরিক্ত চাপগ্রস্ত বাহিনী।

  • রাজনৈতিক হিসাব: প্রতিক্রিয়া, মেরুকরণ বা অস্থিরতার ভয়ে সিদ্ধান্তহীনতা।

  • কৌশলগত সহনশীলতা: সবচেয়ে বিপজ্জনক—যেখানে সহিংসতাকে ভয় সৃষ্টি, বিরোধী কণ্ঠ দুর্বল করা বা নাগরিক পরিসর পুনর্গঠনের হাতিয়ার হিসেবে সহ্য করা হয়।

কারণ যাই হোক, ফল একই—সহিংসতা সামাজিক অনুমোদন পায়। রাষ্ট্র যখন স্পষ্ট সীমারেখা টানে না, তখন মব নিজেকে এক ধরনের অনানুষ্ঠানিক ক্ষমতার কাঠামোর অংশ মনে করতে শুরু করে।

৪. অস্ত্র, দায়মুক্তি ও অনিরাপত্তার কাঠামো

অবৈধ অস্ত্রের বিস্তার মোকাবিলা না করে কোনো সমাজ দীর্ঘস্থায়ী মব সহিংসতা সামাল দিতে পারে না। লুট হওয়া, পাচার হওয়া বা অনিবন্ধিত অস্ত্র যখন অপরাধী বা বেসামরিক হাতে থাকে, তখন বিশৃঙ্খলা দ্রুত সামরিকীকরণে রূপ নেয়।

এর ফলাফল প্রায় সব জায়গায় একই—

  • মব রূপ নেয় সশস্ত্র গোষ্ঠীতে

  • অপরাধ ও রাজনৈতিক ভয়ভীতি একাকার হয়ে যায়

  • পুলিশ প্রতিরোধমূলক নয়, আত্মরক্ষামূলক হয়ে পড়ে

  • সাধারণ মানুষ নীরবতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণে আশ্রয় নেয়

এই অবস্থায় রাষ্ট্র আর বৈধ বলপ্রয়োগের একমাত্র কর্তৃত্ব ধরে রাখতে পারে না—যা সার্বভৌমত্বের মূল ভিত্তি। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করতে ব্যর্থ হওয়া তাই শুধু নিরাপত্তা ঘাটতি নয়; এটি রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের কৌশলগত আত্মসমর্পণ

৫. গণমাধ্যম ও সংস্কৃতির ওপর আঘাত: রাষ্ট্রের বিবেক দগ্ধ

গণমাধ্যম, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও শিল্পচর্চা গণতন্ত্রের বিলাসিতা নয়; এগুলো তার নৈতিক অবকাঠামো। এগুলোর ওপর আঘাত মানে স্মৃতি, সমালোচনা ও কল্পনাশক্তির ওপর আঘাত।

যখন সাংবাদিক হুমকির মুখে পড়েন, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান পুড়ে যায় বা স্তব্ধ হয়ে পড়ে—

  • সত্য বলা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে

  • ভিন্নমত আইন ছাড়াই অপরাধে পরিণত হয়

  • ইতিহাস ও স্মৃতি জোরপূর্বক পুনর্লিখিত হয়

  • সমাজ আত্মপর্যালোচনার ক্ষমতা হারায়

যে রাষ্ট্র তার বিবেক রক্ষা করতে পারে না, সে রাষ্ট্র দীর্ঘমেয়াদে তার বৈধতাও রক্ষা করতে পারে না। বিবেক ছাড়া ক্ষমতা কিছুদিন টিকে থাকতে পারে—চিরদিন নয়।

৬. শাসনের উপকরণ হিসেবে বিশৃঙ্খলা

প্রচলিত ধারণার বিপরীতে, বিশৃঙ্খলা সবসময় ক্ষমতাকে দুর্বল করে না। কিছু প্রেক্ষাপটে নিয়ন্ত্রিত বিশৃঙ্খলা শাসনের কৌশলে পরিণত হয়।

ভয় ঐক্য ভাঙে।
অনিশ্চয়তা যৌথ প্রতিবাদকে নিরুৎসাহিত করে।
সহিংসতা জবাবদিহি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।

ভীত সমাজ সংস্কারের চেয়ে টিকে থাকার কথা ভাবে। কিন্তু এই কৌশল আত্মঘাতী। বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে থাকে না। একসময় তা প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে, আন্তর্জাতিক আস্থা নষ্ট করে এবং শাসনব্যবস্থাকেই গ্রাস করে।

ইতিহাস স্পষ্ট—যে রাষ্ট্র বিশৃঙ্খলাকে স্বাভাবিক করে তোলে, সে শেষ পর্যন্ত তার নিয়ন্ত্রণ হারায়

৭. সিদ্ধান্তের মুহূর্ত: সামনে কোন পথ

বাংলাদেশের সামনে এখনও বিকল্প আছে—কিন্তু সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। আস্থা ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজন দৃশ্যমান ও নীতিনিষ্ঠ পদক্ষেপ—

  1. রাজনৈতিক বা সামাজিক পরিচয় নির্বিশেষে মব সহিংসতার বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা

  2. অবৈধ অস্ত্র দ্রুত ও স্বচ্ছভাবে উদ্ধার

  3. কেবল অংশগ্রহণকারী নয়, পরিকল্পনাকারী ও উসকানিদাতাদের জবাবদিহি

  4. গণমাধ্যম, সংস্কৃতি ও নাগরিক পরিসরের কার্যকর সুরক্ষা

  5. নাগরিক নিরাপত্তাকে রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা

একই সঙ্গে নাগরিক সমাজের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই মুহূর্তে নীরবতা নিরপেক্ষতা নয়—নীরবতা সম্মতির নামান্তর।

উপসংহার: বাংলাদেশ কি ভয়ের রাষ্ট্রে পরিণত হবে?

বাংলাদেশ আজ দুই পথের মোড়ে। এক পথ আইনের শাসন, নাগরিক মর্যাদা ও প্রাতিষ্ঠানিক বিশ্বাসযোগ্যতার। অন্য পথ মব শাসন, ভয়নির্ভর রাজনীতি ও দীর্ঘস্থায়ী অস্থিরতার।

যে রাষ্ট্র দুষ্টের লালন করে ও শিষ্টকে দমন করে, সে রাষ্ট্র হয়তো অল্প সময় শক্তিশালী মনে হতে পারে—কিন্তু ভিতরে ভিতরে শূন্য হয়ে যায়। আইন যেখানে সহিংসতায় প্রতিস্থাপিত হয়, আর আস্থার জায়গা নেয় ভয়—সেখানে কোনো রাষ্ট্র টেকসই হতে পারে না।

প্রশ্নটি তাই অলংকারমূলক নয়:

বাংলাদেশ কি আইনের দ্বারা শাসিত রাষ্ট্র থাকবে, না কি এমন এক মঞ্চে পরিণত হবে—যেখানে সহিংসতাবাদীরা নেতৃত্ব দেয়, আর রাষ্ট্র নীরব দর্শক হয়ে থাকে?

উত্তর এখনই দিতে হবে—আগুন সবকিছু গ্রাস করার আগেই।

লেখক: মিনহাজ সামাদ চৌধুরী
বাংলাদেশের একজন স্বাধীন মানবাধিকার রক্ষক

ফোকাস: রাষ্ট্রীয় সহিংসতা • রাজনৈতিক অধিকার • ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার • বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক জবাবদিহি


Related Topics: 


বাংলাদেশে মব ভায়োলেন্সের উত্থান: রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা, বিচারহীনতা ও সহিংসতার স্বাভাবিকীকরণ


তারেক রহমানের জনপরিচয়ের কৌশলগত বিবর্তনের মূল্যায়ন



No comments:

Post a Comment

Please validate CAPTCHA