বাংলাদেশে মব ভায়োলেন্স: কেন স্বাধীন আন্তর্জাতিক নজরদারি এখন একটি গণতান্ত্রিক অপরিহার্যতা - Bangladesh HR Defender | Human Rights, Rule of Law & Accountability

Latest

Thursday, December 25, 2025

বাংলাদেশে মব ভায়োলেন্স: কেন স্বাধীন আন্তর্জাতিক নজরদারি এখন একটি গণতান্ত্রিক অপরিহার্যতা

 


আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য একটি সচেতনতা-বর্ধক প্রবন্ধ

গত কয়েক মাসে বাংলাদেশে—বিশেষত রাজধানী ঢাকায়—মব ভায়োলেন্স, সংঘবদ্ধ হামলা ও লক্ষ্যভিত্তিক ভয়ভীতি প্রদর্শনের ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব ঘটনা বিচ্ছিন্ন অপরাধ নয়। সামগ্রিকভাবে এগুলো সহিংসতা প্রতিরোধ, নাগরিক সুরক্ষা এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রের পদ্ধতিগত ব্যর্থতার একটি সুস্পষ্ট চিত্র তুলে ধরে—যা আইনের শাসনের মৌলিক দায়িত্বের পরিপন্থী।

৮ আগস্ট ২০২৪ তারিখে বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে ধারাবাহিকভাবে সংঘটিত মব ভায়োলেন্স রাষ্ট্রের সক্ষমতা, রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং প্রাতিষ্ঠানিক নিরপেক্ষতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে। সাংবাদিক, সংবাদমাধ্যম, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী এবং সাধারণ নাগরিক—এমনকি শিশু পর্যন্ত—অগ্নিসংযোগ, নির্মম সহিংসতা ও ভয়ভীতির শিকার হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে জরুরি উদ্ধার ও ফায়ার সার্ভিস কার্যক্রমে বাধা প্রদান মানবিক ক্ষতিকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

এই বাস্তবতা শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়—এটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্যও গভীর উদ্বেগের কারণ।

কেন মব ভায়োলেন্স শুধু আইনশৃঙ্খলার সমস্যা নয়, বরং শাসনব্যবস্থার সংকট

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ড অনুযায়ী রাষ্ট্রের একটি “due diligence obligation” বা যথাযথ দায়িত্ব রয়েছে—সহিংসতা প্রতিরোধ করা, ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেওয়া, অপরাধের তদন্ত করা এবং কার্যকর প্রতিকার নিশ্চিত করা।

যখন সহিংসতার আগে প্রকাশ্য হুমকি বা সংঘবদ্ধ প্রস্তুতির লক্ষণ থাকে, তখন তা প্রতিরোধে ব্যর্থ হওয়া কেবল প্রশাসনিক অক্ষমতা নয়—বরং অবহেলা কিংবা রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবের গুরুতর ইঙ্গিত বহন করে।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, রাজধানীতে—যেখানে রাষ্ট্রের সব প্রধান নিরাপত্তা বাহিনীর সদর দপ্তর অবস্থিত—সেখানে ধারাবাহিক মব ভায়োলেন্স রাষ্ট্রীয় জবাবদিহির কার্যকারিতা নিয়ে গভীর সন্দেহ সৃষ্টি করেছে।

মব ভায়োলেন্স সাধারণত বিকশিত হয় যখন—

  • বিচারহীনতা স্বাভাবিক হয়ে ওঠে

  • তদন্ত প্রক্রিয়া বিলম্বিত বা অস্বচ্ছ থাকে

  • ভুক্তভোগীরা সুরক্ষা পায় না

  • অপরাধীরা নিশ্চিত থাকে যে তাদের কোনো শাস্তি হবে না

এই পরিস্থিতিতে আইনের শাসনের পরিবর্তে ভয়ভিত্তিক ‘গণশাস্তি’ সমাজে জায়গা করে নেয়।

মৌলিক অধিকার ও নাগরিক পরিসরের ওপর প্রভাব

এই সহিংসতার প্রভাব শুধু তাৎক্ষণিক ক্ষতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়—

  • মিডিয়া স্বাধীনতা ক্ষতিগ্রস্ত হয় যখন সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যম লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়

  • সংখ্যালঘু অধিকার বিপন্ন হয় যখন পরিচয়ভিত্তিক সহিংসতার বিচার হয় না

  • সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা সংকুচিত হয় যখন শিল্প ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা হয়

  • রাজনৈতিক অধিকার দুর্বল হয় যখন জনজীবনে ভয় প্রাধান্য পায়

  • গণতান্ত্রিক জবাবদিহি ভেঙে পড়ে যখন নাগরিকরা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থা হারায়

ভয়ের পরিবেশে কোনো অর্থবহ নাগরিক অংশগ্রহণ কিংবা বিশ্বাসযোগ্য গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সম্ভব নয়।

কেন অভ্যন্তরীণ প্রতিকার ব্যবস্থা আর আস্থা সৃষ্টি করতে পারছে না

প্রাথমিকভাবে বিচার নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার। কিন্তু যখন—

  • তদন্তে স্বচ্ছতা থাকে না

  • জবাবদিহি হয় নির্বাচনী বা পক্ষপাতদুষ্ট

  • সাক্ষীরা প্রতিশোধের আশঙ্কায় নীরব থাকে

  • কোনো দৃশ্যমান প্রতিরোধমূলক প্রভাব দেখা যায় না

তখন আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততা শুধু বৈধ নয়—বরং অপরিহার্য হয়ে ওঠে।

এটি সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ নয়; বরং দেশীয় প্রতিকার ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা ভেঙে পড়ার যৌক্তিক প্রতিক্রিয়া

কেন স্বাধীন আন্তর্জাতিক নজরদারি প্রয়োজন

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্বাধীন আন্তর্জাতিক অনুসন্ধান ও তথ্য-অনুসন্ধান কমিশনগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে—

  • ঘটনার নিরপেক্ষ সত্য উদঘাটনে

  • বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে রাজনৈতিক বিতর্কে না টেনে কাঠামোগত সমস্যা চিহ্নিত করতে

  • প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও সহিংসতা প্রতিরোধে সহায়তা করতে

  • রাষ্ট্রীয় বিশ্বাসযোগ্যতা পুনরুদ্ধারে

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই নজরদারি তিনটি মৌলিক উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারে—

  1. সত্য উদঘাটন: কী ঘটেছে, কেন ঘটেছে এবং কীভাবে সহিংসতা সম্ভব হয়েছে

  2. জবাবদিহি: দায়ী ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা চিহ্নিত করা

  3. প্রতিরোধ: ভবিষ্যতে সহিংসতা ঠেকাতে সুপারিশ প্রণয়ন

এটি রাষ্ট্রকে দুর্বল করে না—বরং প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করে।

সময় কেন এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ

জাতীয় নির্বাচন সামনে থাকায় পরিস্থিতির গুরুত্ব আরও বেড়েছে। ভয়, সহিংসতা ও বিচারহীনতার পরিবেশে অনুষ্ঠিত নির্বাচন জনগণের আস্থা ও আন্তর্জাতিক বিশ্বাসযোগ্যতা—দুটোই হারানোর ঝুঁকিতে থাকে

সময়োপযোগী আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততা—

  • সহিংসতা প্রশমনে সহায়ক হতে পারে

  • ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দিতে পারে

  • নাগরিক পরিসর রক্ষা করতে পারে

  • নির্বাচনকালীন অস্থিরতা প্রতিরোধ করতে পারে

নীরবতা বা বিলম্ব, বিপরীতে, সহিংস গোষ্ঠীকে আরও উৎসাহিত করতে পারে।

দায়িত্বশীল আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততার আহ্বান

মানবাধিকার, গণতান্ত্রিক শাসন ও সংঘাত প্রতিরোধে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত মব ভায়োলেন্সকে পরবর্তী সংকটের পর্যালোচনা নয়, বরং আগাম সতর্ক সংকেত হিসেবে বিবেচনা করা।

স্বাধীন নজরদারি, নীতিনির্ভর সম্পৃক্ততা এবং প্রতিরোধমূলক কূটনীতি এখনও পার্থক্য গড়ে দিতে পারে।

লক্ষ্যটি স্পষ্ট ও জরুরি—
যাতে সহিংসতা স্বাভাবিক না হয়ে ওঠে, বিচারহীনতা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ না পায়, এবং ভয় গণতন্ত্রকে ভেতর থেকে ফাঁপা করে না দেয়।


উপস্থাপন করেছেন

মিনহাজ সামাদ চৌধুরী
স্বাধীন মানবাধিকার কর্মী, বাংলাদেশ

কেন্দ্রীয় বিষয়:
রাষ্ট্রীয় সহিংসতা • গণমাধ্যমের স্বাধীনতা • সংখ্যালঘু অধিকার • রাজনৈতিক অধিকার • গণতান্ত্রিক জবাবদিহি

Related Topics: 


বাংলাদেশে মব ভায়োলেন্সের উত্থান: রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা, বিচারহীনতা ও সহিংসতার স্বাভাবিকীকরণ


তারেক রহমানের জনপরিচয়ের কৌশলগত বিবর্তনের মূল্যায়ন

No comments:

Post a Comment

Please validate CAPTCHA